হেমন্ত কি হারিয়ে গেল বাংলা কবিতা থেকেও?

শরত-পরবর্তী সময়ে, পেঁজা তুলাহীন মেঘমুক্ত আকাশে, নদীতীরে বৃদ্ধকেশ ঝরে যাওয়া কাশের বনে এসেছে হেমন্তের বেলা। সকালে শেফালি আর রাঙিয়ে তোলে না মাটি, তার বদলে হৈমন্তী শিরশিরানি দক্ষিণা বাতাস শীতের আমেজ এনে দিচ্ছে। জানি না, শহুরে হাওয়াতে আজও ভাসে কিনা হেমন্তের চিঠি। উদাস শহুরে যুবতি আধঘুমে হেঁটে যায় কিনা শিশিরধৌত ঘাসের উপর দিয়ে! বাঙালির হেমন্ত কি হারিয়ে গেল নিরুদ্দেশের পথে?

গ্রামে তো আজও অলৌকিকতা ঘটে! গ্রাম এক অলৌকিক ভূমি, যেখানে প্রতিটা ঋতু তার ঝুলি থেকে জাদুর ফুলঝুরি ছড়িয়ে দিয়ে যায়। এখানে গ্রীষ্মের দাবদাহের পর বর্ষার প্রলেপ এসে ভিজিয়ে দেয় মন, আবার শরতের এলোমেলো মেঘমালা উদায় করে তোলে আমাদের। আমরা হেমন্তের আমেজে শিহরিত হতে হতে শীত এসে মেলে ধরে আর তারপরই বসন্তের হাত চিঠি গাছে গাছে পলাশে পলাশে উড়ে উড়ে এসে বলে দেয় - আবারও একটা বছর চলে গেলো! আবার আসবে গ্রীষ্মকালীন বেলা।

তবে হেমন্তের আমেজ কিছুটা আলাদা, কারণ নলেন গুড়ের গন্ধ মাখা দুপুর হোক আর রাঢ়বঙ্গের গ্রামে গ্রামে গোটা কার্তিক মাসের ভোর জুড়ে 'রাই জাগো রাই' ভোরাইয়ের গান হোক, গ্রামের ঋতু সৌন্দর্যে হেমন্ত নবান্নের নতুন ধানের উপর শিশিরকণার মতো সজীব। তাই তো সেই মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব কবি লোচনদাস বলেন – ‘অগ্রাণে নোতুন ধান্য বিলাসে।/ সর্বসুখ ঘরে প্রভু কি কাজ সন্ন্যাসে ॥/পাটনেত ফোটে ভোটে শয়ন কম্বলে।/ সুখে নিদ্রা যাও তুমি আমি পদ তলে।’ হ্যাঁ, হেমন্তের অঘ্রাণে নতুন ধানেই নবান্ন উৎসব হবে গ্রামে গ্রামে, সে উৎসবের কী আনন্দ তা রাঢ়দেশে না এলে কল্পনা করাও মুশকিল। এই নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করেই বাড়ির মেয়েরা শ্বশুরঘর থেকে আবার বাপের বাড়িতে ফিরে আসে, বাড়ির উঠোন সোনালি ধানে ভরে থাকে।

রাঢ়দেশের আর একজন বৈষ্ণব কবি গোবিন্দদাস লিখেছেন –‘আঘাণ মাস রাস রস সায়র/নায়র মাথুরা গেল।/পুর রঙ্গিনীগণ পুরল মনোরথ/বৃন্দাবন বন ভেল।।’ তবে হেমন্ত নিয়ে আধুনিক কবিরাও পিছিয়ে নেই, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই বলছেন নৈবেদ্য কবিতায় – ‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে/জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে/শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার/রয়েছে পড়িয়ে শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার /স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’ এই শান্ত চরাচরকে দেখে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম লিখেছেন –‘হেমন্তের ঐ শিশির নাওয়া হিমেল হাওয়া/সেই নাচনে উঠল মেতে।/টইটুম্বুর ঝিলের জলে/ ফাঁটা রোদের মানিক জ্বলে/চন্দ্র ঘুমায় গগন তলে/ সাদা মেঘের আঁচল পেতে।’ কবি নজরুল হেমন্তের প্রবাহিত ধারাতে অবগাহন করে লেখেন – ‘ঋতুর খাঞ্চা ভরিয়া এল কি ধরণীর সওগাত।/ নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হল মাৎ।/ গিন্নি পাগল চালের ফিরনি/তরী ভরে নবীনা গিন্নী/হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীদের খুশিতে কাঁপিছে হাত।/শিরনি বাঁধেন বড় বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেস্মাত।’ এখানেও আমরা হেমন্তের নতুন ধানের উৎসবে গৃহস্থের বাড়িতে উৎসবের চিত্রটি খুঁজে পাই। পল্লিকবি জসীমউদ্দিন লিখেছিলেন - 'আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান,/সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান। /ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়ায় বায়ু/কলমি লতায় দোলন লেগেছে, ফুরাল ফুলের আয়ু।'

আবার, রবীন্দ্র-পরবর্তী আধুনিক কবিদের কাছেও হেমন্ত এসেছে একবারে অন্যভাবে, কবি জীবনানন্দ দাশ তো হেমন্তের রিক্তবেলার বিবর্ণতাকে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে তাঁর 'অঘ্রাণ' কবিতাতে- 'আমি এই অঘ্রাণেরে ভালোবাসি-বিকেলের এই রং-রঙের শূন্যতা/রোদের নরম রোম-ঢালু মাঠ-বিবর্ণ বাদামি পাখি-হলুদ বিচালি/পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে ঘাসে কুড়ানির মুখে তাই নাই কোনো কথা,/ধানের সোনার কাজ ফুরায়েছে জীবনেরে জেনেছে সে কুয়াশায় খালি/তাই তার ঘুম পায়-ক্ষেত ছেড়ে দিয়ে যাবে এখনি সে ক্ষেতের ভিতর/এখনি সে নেই যেন ঝড় পড়ে অঘ্রাণের এই শেষ বিষণ্ণ সোনালি।' নকশিকাঁথার মাঠে হেমন্তের আবাহন আসলেও এপার বাংলার কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত লেখেন – ‘ধূমায়িত রিক্ত মাঠ, গিরিতট হেমন্ত লোহিত/তরুণ তরুণী শূন্য বনবীথি চ্যুত পত্রে ঢাকা, /শৈবালিত স্তব্ধ হ্রদ, নিশাক্রান্ত বিষণ্ণ বলাকা/ম্লান চেতনারে মোর আকস্মাৎ করেছে মোহিত।’ এই মোহিত অবস্থা ছিল কবি জীবনানন্দ দাশেরও, তার অন্যতম প্রিয় ঋতু ছিল হেমন্ত, তাই তিনি যখন লেখেন – ‘মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায়/ কার্তিকে জ্যোৎস্নার প্রান্তরে’, তখন আমরা বুঝতে পারি, এই জ্যোৎস্না হল সেই শাশ্বত জ্যোৎস্না, যেখানে কবিসত্তার মেলবন্ধন হয় মানবসত্তায়।

কবি আল মাহমুদ লেখেন- ' আজ এই হেমন্তের জলজ বাতাসে/আমার হৃদয় মন মানুষীর গন্ধে ভরে গেছে/রমণীর প্রেম আর লবণ সৌরভে/আমার অহংবোধ ব্যর্থ আত্মতুষ্টির ওপর/বসায় মার্চের দাগ, লাল কালো কট ও কষায়।' হেমন্ত তো এমনই, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাই হেমন্তের অরণ্যে পোস্টম্যান হয়ে প্রকৃতির হাতচিঠি পৌঁছে দেন মানুষের রুদ্ধদুয়ারে। সে দুয়ারের দ্বার শীতের আগে খুললেও স্পর্শসুখ মরমে পৌঁছায় তো?

বিশ্বকবি অবশ্য শরৎ নিয়ে তিরিশটির বেশি গান লিখলেও হেমন্তকে নিয়ে তাঁর গান নেই বললেই চলে, হয়ত দু একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন – ‘শিশিরে শিশিরে অরুণমালিকা উঠেতেছে ছলোছলি।।’, তাতে বোঝা কঠিন এটা শরত না হেমন্তের গান! কিন্তু এই বাংলার হেমন্তে ভরে ওঠা গ্রামে গ্রামে ধানের মড়াইয়ে সোনালি ধানে, ধান কাটার পর ইঁদুরের গর্তে কিভাবে ইগল নেমে আসে তা গ্রামে আজও উজ্জ্বল। পশ্চিমের দেশে অবশ্য হেমন্তের একটা আলাদা প্রভাব আছে, সেখানে মেপল পাতা লাল, ওক পাতা বাদামি বা বার্চের পাতা হলুদ হলে পাশ্চাত্য কবিদের মনও রঙিন হয়ে ওঠে, এই বাংলায় তা হয় না। তাই নতুন শতাব্দীর আধুনিক কবিরা শীতের আমেজে ভেসে হেমন্তের গুণকীর্তন করেছেন কিন্তু বাকি কবিরা একবারে চুপ কেন? হেমন্তের অরণ্য কি তাদের দু-হাত খুলে ডাকে না?

More From Author See More