বাদ্যযন্ত্রেই মিশে তাঁর পরিচয়; রাগসঙ্গীত-চর্চায় বাঙালি শিল্পীর ‘বন্ধু’ ম্যান্ডোলা

“নামের পিছনে পদবি একটা ছিল। এখনও আছে। ব্যাঙ্কে কাজে লাগে। আর ছোটোবেলার পরীক্ষার সার্টিফিকেটে থেকে গিয়েছে।” যন্ত্রের সঙ্গে নিজের পরিচয় যে মিলিয়ে ফেলেছেন তিনি। তাঁর নাম তাই ‘ম্যান্ডোলা জয়’। এই ছোট্ট বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে কলকাতার পরিচয়ের সেতু তিনি। একুশ শতকের একেবারে শুরুতে যখন তিনি পেশাদার বাদ্যযন্ত্রী হয়ে আত্মপ্রকাশ করেন, তখনও বাংলার শ্রোতারা জানতেন না ম্যান্ডোলার সুর। ম্যান্ডোলিনের ব্যবহারও তখন প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। তার উপরে রাগসঙ্গীতে এমন বিদেশি যন্ত্রের ব্যবহার তো কল্পনাই করতে পারতেন না কেউ। “ততদিনে কিন্তু কর্ণাটকে ইউ শ্রীনিবাসজি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ম্যান্ডোলিনের ব্যবহার শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু উত্তর ভারত এবং বাংলায় কোনো কারণে সেতার, সরোদ, বাঁশি ছাড়া কোনোকিছুর ব্যবহার করা হত না।” বলছিলেন ম্যান্ডোলা জয়।

ব্যাঙ্কের খাতায় চাপা পড়ে থাকা তাঁর প্রকৃত নাম পুরঞ্জয় গুহ। ১৯৭৫ সালে বরানগরে জন্ম তাঁর। কিছুদিনের মধ্যেই চলে যেতে হয় উত্তরপাড়া। বাদ্যযন্ত্রের প্রতি আগ্রহ সেই ছেলেবেলা থেকেই। তাঁর কথায়, “যখন যে যন্ত্রের কথা জানতে পেরেছি, সেটাই বাজিয়েছি। শিখেছি নিজে নিজে।” সঙ্গীতের প্রথাগত শিক্ষা হয়েছে অনেক দেরিতে। তার আগেই আপন করে নিয়েছেন ম্যান্ডোলিন নামের ছোট্ট বিদেশি যন্ত্রটিকে। কিন্তু তার মধ্যেই অনায়াসে তুলে নিতেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুর। একেবারে প্রথমে ভি জি যোগ সাহেবের বেহালার সুরে আকর্ষণ তৈরি হয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিষয়ে। তারপর ওস্তাদ আমজাদ আলি খানের সরোদ শুনে শুনে সেই সুর ম্যান্ডোলিনে তুলতে শুরু করেন।

প্রথাগত সঙ্গীতশিক্ষার সুযোগ মেলে ১৯৯৬ সালে। এক বন্ধুর সূত্রে যোগাযোগ হয়ে যায় বেহালাবাদক পদ্মভূষণ পন্ডিত ভি জি যোগসাহেবের সঙ্গে। পরবর্তীতে তালিম নিয়েছেন সরোদীয়া পদ্মভূষণ পণ্ডিত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। বর্তমানে তালিম নিচ্ছেন সেতারশিল্পী পণ্ডিত পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। আর এর বছর চারেকের মধ্যেই ম্যান্ডোলিনের বদলে বেছে নিলেন ম্যান্ডোলা যন্ত্রটিকে। তাঁর তখন মনে হয়েছিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জন্য ম্যান্ডোলিনের থেকে ম্যান্ডোলা খানিকটা বেশি উপযোগী। তবে এই বিদেশি যন্ত্রটির সঙ্গে দেশীয় সুর মিলিয়ে নেওয়ার কাজটা সহজ ছিল না। নানা ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে যেতে হয়েছে অবিরত।

“প্রথমেই আমি যেটা করেছিলাম, ম্যান্ডোলার প্লেকট্রামের পরিবর্তে ব্যবহার করতে শুরু করেছিলাম নারকেল মালার জবা।” বলছিলেন তিনি। এই নারকেল মালার জবা সাধারণত সরোদের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়। তবে এর পরেও খানিকটা পার্থক্য থেকে যাচ্ছিলই। শিল্পীর কথায়, ভারতীয় সঙ্গীতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মীড়। সেটাকে ঠিকঠাক বজায় রাখাই ছিল একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ। তাই ধীরে ধীরে যন্ত্রের গঠনগত নানা পরিবর্তনও করেছেন তিনি। ফাঁপা যন্ত্রটিকে সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি সলিড বডিতে পাল্টে ফেলেছেন। কিন্তু এর পরেও ফ্রেটের সমস্যা থেকেই যাচ্ছিল। তাই তিনি সরোদের মতো করে পিতলের পাতে বানিয়ে নিলেন ফিঙ্গারবোর্ড। আর এই পুরো কাজটাতে তাঁকে সমানে সহোযোগিতা করে গিয়েছেন বাদ্যযন্ত্র নির্মাতা মিন্টু বিশ্বাস। শিল্পীর কথায়, “মিন্টুর বয়স বেশি নয়। কিন্তু ওর মতো দক্ষ নির্মাতা আমি কমই দেখেছি।” এখন তাঁর যন্ত্র সম্পূর্ণ। আর এই যন্ত্রের একটা নামও রেখেছেন তিনি। ‘শ্রীতার’। দেশবিদেশের নানা অনুষ্ঠানে তাঁর নিজের আবিষ্কৃত যন্ত্রে সুর তুলে বারবার মুগ্ধ করে চলেছেন শ্রোতাদের।

আরও পড়ুন
তাজমহলের দেওয়ালে ক্যালিগ্রাফি তাঁরই; পাঞ্জাবের গ্রামে ধুঁকছে বিস্মৃতপ্রায় শিল্পীর শেষ চিহ্ন

তবে এখনও নিজেকে সঙ্গীতের ছাত্র মনে করতেই পছন্দ করেন জয়। এখনও হাতের কাছে নতুন কোনো যন্ত্র পেলেই সেটা বাজাতে ইচ্ছা হয় তাঁর। রাবাব, বাঁশি, নেপালি সারেঙ্গি, রবনহাট্টা, তবলা, হারমোনিকা, দোতারা – শিখেছেন সবই। আর এইসমস্ত যন্ত্র শিখতে গিয়ে নিজেই অনুভব করেছেন একটি দায়িত্ব। যেসব বাদ্যযন্ত্র ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে, বাঁচিয়ে রাখতে হবে তাদের ব্যবহার। লোকগানের চর্চার সঙ্গে সঙ্গে যেন লোকবাদ্যের চর্চাও চলে সমানে। 

ভাবলে অবাক হতে হয়, ডুগডুগিকেও তিনি ভারতীয় সঙ্গীতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাদ্যযন্ত্র বলে মনে করেন। একের পর এক বোল উচ্চারণ করে তিনি বলেন, “এই সমস্তকিছু ডুগডুগিতে বাজানো যায়। কারোর বিশ্বাস না হলে আমি নিজে বাজিয়ে দেখিয়ে দিতে পারি।” ইতিমধ্যে বাংলা এবং বাংলার বাইরের নানা রাজ্যের বিভিন্ন লোকশিল্পীকে নিয়ে কাজ শুরু করার পরিকল্পনাও করে ফেলেছেন তিনি। করোনা পরিস্থিতিতে সেই কাজ খানিকটা ব্যাহত হয়েছে। কিন্তু খুব শিগগিরি আবার পুরোদমে শুরু হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। “কাউকে তো এগিয়ে আসতে হবে।” সঙ্গীতের জগত যে এক সাধনার জগত। আর সুরের সাধনাকেই জীবনের মূলমন্ত্র করে নিয়েছেন পুরঞ্জয় গুহ, ওরফে ম্যান্ডোলা জয়। অবশ্য তিনি মনে করেন, সবটাই পেরেছেন তাঁর স্ত্রী শ্রীপর্ণা মজুমদারের জন্য। এভাবে কেউ পাশে না থাকলে তিনি পারতেন না। এভাবেই এগিয়ে চলুক এই যৌথ সাধনা। আর আরও বেশি বেশি করে সুরে মোহিত হয়ে পড়ুক এই হিংসা-বিধ্বস্ত পৃথিবী।

আরও পড়ুন
৩০ বছর আগে প্রয়াত শিল্পীর গানেই স্বৈরাচার থেকে মুক্তির স্বপ্ন বুনছে বেলারুশ

Powered by Froala Editor

More From Author See More