৫৮ বছর আগেও চিন-ভারত যুদ্ধে ভারতের ট্রাম্প কার্ড তিব্বতী সেনারা, পরিকল্পনায় এক বাঙালি

বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচতে বন্ধু খুঁজে নিতে হয় সবাইকেই। তবে ওই যে, হাত বাড়ালেই বন্ধু পাওয়া যায় না। কিন্তু ইতিহাসে কিছু কাহিনি তো থেকে যায় রূপকথার মতো। স্পেশাল ফ্রন্টেয়ার ফোর্সের কাহিনিকেও তাই রূপকথা বললে অত্যুক্তি হয় না। এই পৃথিবীতে বোধহয় আর কোনো সামরিক বাহিনী নেই, যার সদস্যরা একসঙ্গে দুই দেশের পতাকা তুলে ধরে।

ভারতীয় সেনাবাহিনীতে অবশ্য প্রথম থেকেই তিব্বতের বেশ কিছু সৈনিক থাকত। সেদেশে তখনও একটা আস্ত বাহিনী তৈরির মতো পরিকাঠামোও ছিল না, আর প্রয়োজনও ছিল না। কিন্তু ঠান্ডা যুদ্ধের সময় থেকেই অবস্থা বদলাতে শুরু করে। রাশিয়ার পরেই আমেরিকার সামনে অন্যতম প্রতিপক্ষ হিসাবে হাজির হয় চিন। আর চিনের কমিউনিস্ট সরকারের তিব্বত নীতির মধ্যে যে জটিলতার জন্ম, তাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার সুযোগ কি ছেড়ে দেওয়া যায়?

তিব্বতের ভূখণ্ডে ঢুকে চিনা বাহিনীর আধিপত্য স্থাপন মেনে নিতে পারেননি সাধারণ মানুষ। তাঁদের প্রিয় দলাই লামার অপমানও সহ্য করতে পারেননি। এই সমস্তকিছু নিয়েই প্রতিশোধের আগুন জমা হচ্ছিল। কিন্তু সেটা দানা বাঁধার কোনো জায়গা পাচ্ছিল না। ১৯৬১ সালে ভারতে পালিয়ে আসা তিব্বতীয় রিফিউজিদের নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তোলেন খোদান্দেরা থিম্মা। ততদিনে ভারত-চিন যুদ্ধের প্রেক্ষাপট প্রস্তুত। কিন্তু সেই যুদ্ধে এই তিব্বতী বাহিনীর সাহায্য নেওয়ার বিষয়ে কোনো গুরুত্বই দেননি প্রধানমন্ত্রী নেহেরু অথবা প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন। কিন্তু পরিস্থিতি যখন ক্রমশ চিনের হাতেই ধরা দিচ্ছিল, তখন বিকল্প পথের হদিশ খুঁজতেই হল।

১৯৬২ সালে তৈরি হল বিশেষ সীমান্ত বাহিনী। তখনও যে এ বিষয়ে নেহেরু বা কৃষ্ণ মেনন খুব আশাবাদী, এমনটা নয়। বিশেষ করে একটা কথা ভাবতেই হত, তিব্বতীরা কোনোদিনই ভারতকে নিজেদের দেশ বলে মেনে নেবে না। তারা সবসময় লামার নেতৃত্বাধীন স্বাধীন দেশের স্বপ্নই দেখবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না মন্ত্রীদের। সব দিক ভেবে আমেরিকার গোয়েন্দা বিভাগ সিআইএ এবং ভারতের ইন্টালিজেন্স ব্যুরো, দুই দলেরই সদস্যরা জানিয়ে দিয়েছেন যুদ্ধে ভারতের ঘুরে দাঁড়ানোর একমাত্র ট্রাম্প কার্ড হতে পারে তিব্বতী অনুপ্রবেশকারীরাই। আর তাদের আনুগত্য নিয়েও সন্দেহের অবকাশ নেই বলে জানিয়ে দিয়েছিল দুই পরিষদের রিপোর্ট।

আরও পড়ুন
চিনের মাটিতে তৈরি হচ্ছে ভারতীয় চিকিৎসকের ব্রোঞ্জ মূর্তি - দ্বন্দ্বের মধ্যে মৈত্রীর বার্তা?

তবে বিশেষ সীমান্ত বাহিনী গড়ে তোলার বিষয়ে নেহেরুকে মূলত রাজি অরিয়েছিলেন একজন বাঙালি। তিনি ছিলেন ইন্টালিজেন্স ব্যুরোর সেকেন্ড ডিরেক্টর ভোলানাথ মল্লিক, ওরফে বি. এন.  মল্লিক। এর আগে অবশ্য তিনি আসাম উপত্যকার মানুষদের নিয়ে অনুরূপ বাহিনী গড়ে তোলার কথা জানিয়েছিলেন। তাঁর চেষ্টাতেই শেষ পর্যন্ত তিব্বতীদের নিয়ে বাহিনী তৈরি হল। সিআইএ এবং আইবি, দুই পরিষদই এই বাহিনীর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নিল।

১৯৬২ সালের ২০ অক্টোবর ম্যাক-মোহন লাইনের সংঘর্ষ দিয়ে পথচলা শুরু স্পেশাল ফ্রন্টেয়ার ফোর্সের। পাশাপাশি চলছিল আধুনিক যুদ্ধবিদ্যার নানা প্রকরণ শেখার কাজও। কিন্তু প্রযুক্তি নয়, যুদ্ধে এই বাহিনীর অসম্ভব সাফল্যের পিছনে শুধু কাজ করেছিল প্রতিহিংসার অনুভূতি। সামনে যে বাহিনী আছে সেটা লামার শত্রু, বুদ্ধের শত্রু আর তাই তিব্বতের শত্রু। তার হাতে পরাজয় মেনে নেওয়া যায় না।

আরও পড়ুন
চিনের অধিগ্রহণের শিকার এবার নেপালও, পরিবর্তন নদীর গতিপথেও

তবে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে জায়গা হল না তিব্বতের সৈনিকদের। এই স্পেশাল ফ্রন্টেয়ার ফোর্সকে রাখা হল আইবির তত্ত্বাবধানে। পরবর্তীকালে রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং (র) এর হাতে দায়িত্ব যায়। তবে তার থেকেও খারাপ বিষয় দীর্ঘদিন পর্যন্ত বেতন থেকে শুরু করে অন্যান্য পরিষেবার বিষয়ে বারবার পক্ষপাতিত্বের শিকার হয়েছেন তাঁরা। কিন্তু তাতে আনুগত্যের অভাব দেখা যায়নি কোনোদিন।

এই বিশেষ সীমান্ত বাহিনীর সাফল্য হিসাবে বরাবর ভারত-চিন যুদ্ধের কথা বলা হলেও সমস্ত যুদ্ধেই শেষ পর্যন্ত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এঁরাই। কার্গিল যুদ্ধেও শেষ পর্যন্ত ভারতকে ঘুরে দাঁড়াত সাহায্য করেছে এই বাহিনীই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও ভারতের পক্ষ থেকে লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছিলেন তাঁরা। এমনকি যে এমার্জেন্সির জন্য ইন্দিরা গান্ধী আজও নিন্দিত হন, সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল এই স্পেশাল ফ্রন্টেয়ার ফোর্স। অনেকে তখন একে ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত বাহিনী বলেও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আসলে এর মধ্যে ছিল ভারত রাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রশ্নটাই। যে ভারত ১৯৫৯ সালের চিনের আক্রমণে বিধ্বস্ত তিব্বতবাসীকে এবং লামাকে আশ্রয় প্রদান করেছিল।

আরও পড়ুন
‘অপরাধ’ চিনে জন্মগ্রহণ করা, ’৬২-র যুদ্ধে গুপ্তচর সন্দেহে বন্দি ৩০০০ চিনা-ভারতীয়

আজ আবারও ভারত-চিন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বারবার উঠে আসছে স্পেশাল ফ্রন্টেয়ার ফোর্সের কথা। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তিব্বতী শহিদদের গান স্যালুট দেওয়ার ঘটনা যেন জানিয়ে দিচ্ছে, এবারেও শেষ অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হবে স্পেশাল ফ্রন্টেয়ার ফোর্সকেই। কিন্তু এই দীর্ঘ আনুগত্যের মর্যাদা কি আদৌ রাখতে পেরেছে ভারত সরকার? এই ৬০ বছর ধরে কতটা নিরাপদ বোধ করেছেন তিব্বতের মানুষ? সরকারের নানা তথ্যে দেখা গিয়েছে এখন আর স্পেশাল ফ্রন্টেয়ার ফোর্সে যোগ দিতে চাইছেন না তিব্বতের মানুষরা। তার বদলে গোর্খা সেনাদের নেওয়া হচ্ছে বাহিনীতে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে কি আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি সম্ভব? এ প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
গালওয়ান ভারতেরই অধিকারে, চিনের দাবি কল্পনাপ্রসূত, কড়াভাবে জানালেন বিদেশমন্ত্রী

More From Author See More