যেখানে ঘুমোচ্ছেন মধুসূদন, মৃতদেহে ছায়া দিচ্ছে পরী, কলকাতার হারানো অতীত ও এক কবরস্থান

বিকেলের পড়ন্ত আলো তখন পরীটার ডানায়। যেন উড়তে উড়তে ক্লান্ত পরী দু-ডানা গুটিয়ে বসেছে। তার খোলা চুল। যদিও মুখের আদল ঠিক বোঝা যায় না। সময়ের দীর্ঘ দীর্ঘ প্রলেপ কত যে ক্ষতদাগ এঁকেছে। না, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পরী নয়। এই পরী রয়ে গেছে লোয়ার সার্কুলার সেমেটারিতে। দু’ডানায় সে ছায়া দিয়েছে অগাস্টা শার্লটের কবরটিকে। যার গায়ে আজও খোদাই করা একটি প্রেমের আখ্যান।

একথা ঠিক, শহর কলকাতার লিখিত সংগৃহীত নথির থেকে আরো অনেকটা বিস্তৃত ইতিহাস লেখা রয়েছে কবরগুলির গায়ে। গোটা বেরিয়াল গ্রাউন্ড স্ট্রিট (পার্কস্ট্রিট) জুড়েই রয়েছে কলকাতার প্রাচীন নাগরিকদের স্মৃতিচিহ্নগুলি। এই যে লোয়ার সার্কুলার সেমেটারি, ১৮৪০ সাল থেকে আজও সেসব চিহ্ন ধারণ করে চলেছে। প্রায় ১২০০০ কবর রয়েছে সেখানে। মল্লিকবাজারের মুখেই এই গোরস্থান। কাছেপিঠেই একসময় ছিল কলকাতার ফরাসি গোরস্থান। ছিল নর্থ পার্কস্ট্রিট সেমেটারি। আর ছিল অসংখ্য কবর। যাদের গায়ে খোদাই করা সেসময়কার কথকতা। কিন্তু কবরস্থান বাঁচিয়ে ইতিহাস সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা আমরা উপলব্ধি করিনি, আজও করি না।

এই লোয়ার সার্কুলার সেমেটারিতেই সস্ত্রীক শায়িত মধুসূদন দত্ত। কবরস্থানের এক প্রান্তে, নিরিবিলিতে। রয়েছেন ডেভিড ড্রামন্ডও। তাঁর ধর্মতলা অ্যাকাডেমির কথা আমরা কেই বা ভুলতে পারি। লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর যুক্তিবাদী চেতনার উন্মেষ যেখানে। ডোরিকে কবিতা লিখতেন তিনি। অবশ্য সে পাণ্ডুলিপি নাকি তলিয়ে গেছে সাগরের জলে। ফলে, আর তা পাওয়া সম্ভব নয়। ১৮৪৩ সালে ড্রামন্ড সাহেবকে এখানেই সমাধিস্থ করা হয়। রয়েছেন বেথুন সাহেব। অসংখ্য কবরের ভিড়ে চট করে চোখে পড়তে চায় না তাঁকে। দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ সাহেবের কবরও এখানেই। মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিল তাঁর সুগভীর ঘনিষ্ঠতা। শান্তিনিকেতনে দীর্ঘকাল বসবাস করেছিলেন তিনি। গোরস্থানের শুরুতেই চোখে পড়বে একটি বিরাটকায় কবর। তাতে এক ক্রুদ্ধ পুরুষের মুখ খোদাই করা। রাগী ব্রিটিশ-গোছেরই চেহারা। কবরটি প্রথম ইন্দো-আফগান যুদ্ধে মৃত ব্রিটিশ সেনা স্যার উইলিয়াম হে ম্যাকনাটেনের। শোনা যায়, তাঁর ছিন্নভিন্ন দেহ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরেছিল কলকাতায়। সেটাকেই সমাধিস্থ করা হয় এখানে৷ ভূতের রোমাঞ্চে মানুষের চিরকালীন আকর্ষণ। লোয়ার সার্কুলার সেমেটারির এই কবরটিকে ঘিরে বেশ কিছু ভৌতিক গল্প বাজারে প্রচলিত। যদিও শীতের আসন্ন সন্ধে, হুহু উত্তুরে হাওয়া, আর শনিবারের অমন সুবর্ণ ভুতুড়ে-যোগ সত্ত্বেও ম্যাকনাটেন সাহেব আমায় দেখা দিলেন না।

শ্রীপান্থ জানাচ্ছেন, হিন্দু কলেজের প্রথম হেডমাস্টার জেমস আইজ্যাক ডি অ্যানসেল্মের শেষ শয্যাটিও এখানে। এছাড়া রয়েছেন সাঁ সুসি থিয়েটারের অভিনেত্রী মারিয়া ম্যাডলিন টেলর, ঐতিহাসিক ব্লকম্যানও।

কিন্তু এ তো গেল বিখ্যাত মানুষের ভিড়। অনামা কত যে কবর। তাতে প্রাচীন আখরে কত কী লেখা৷ শুরুতেই যেই কবরটির কথা বলেছি, তা কোনো এক এডওয়ার্ড সাহেব তাঁর প্রিয়তমা পত্নী অগাস্টাস শার্লটের স্মৃতিতে তৈরি করিয়েছিলেন। আমার অজ্ঞ চোখে সাহেবের সঠিক পরিচয় ঠিক ঠাহর হয়নি। ইসাবেলা নাম খোদাই করা আরেকটা কবর খুব চোখে পড়ে। তার পরিচতিগুলি বড়োই আবছা। শুধু পড়া যায় তাঁর অপূর্ব সুন্দর নামখানা। ২৭ বছর ১০ মাস ২০ দিনের মাথায় মৃত্যু হয়েছে জেনের। কবরের গায়ে লেখা - Beloved wife of John Thomas Southey। আর কোনো পরিচিতি নিশ্চিত খুঁজলে মিলবে। কলকাতার প্রাচীন নাগরিকদের হদিশ মিললে না-জানি কত নতুন সত্য ঝিলিক দিয়ে যাবে। ছেচল্লিশ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন অস্কার লুইস ফ্রেজার। তাঁর পিতা ছিলেন একজন প্রাণীবিদ। আর তিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের একজন কর্মী।

একজন লেখকের সন্ধান পেলাম এখানে এসে। হারবার্ট অ্যালিক স্টার্ক। অ্যাংলোইন্ডিয়ান সমাজ ও তার ইতিহাস নিয়ে বেশকিছু লেখা রয়েছে তাঁর। তাঁর কবরটিতে খোদাই করা প্রাচীন ভারতবর্ষের মানচিত্র। দেশভাগের আগের ছবি। গ্রিক টেম্পলের মতো একটি গোর নজর টানছিল থেকেথেকেই। কিন্তু কিছুতেই তার নামপরিচয় বুঝে ওঠা গেল না।

এমনি কত যে প্রাচীন কবর তাদের সুপ্রাচীন দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সেখানে হাজির, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। অথচ, বেশ কিছু কবর ভেঙেচুরে নিঃশেষ। উঠে গেছে খোদাই করা লিপিমালা। ভিনদেশি এইসব নরনারী শিশুরা জীবনের শেষেও আশ্রয় করে থাকবে এখানকার মাটি। আমাদের কাছে তারা চির অচেনা।

লোয়ার সার্কুলার সেমেটারি আজও সচল। মৃত্যুর পর আজও সেখানে কবর পায় খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষ। আর তাদের কবর নির্মাণ, তাতে নামপরিচয় খোদাই, চিত্ররচনা করেন স্থানীয় মুসলমান বাসিন্দারা। স্কেল দিয়ে দাগ কেটে পরম যত্নে বুড়ো দাড়িওয়ালা ইসলামি মানুষ এই কাজ করে চলেছেন। ছবি তুলতে চাইলে রেগে যান। কাজে ব্যাঘাত হচ্ছে। এই দৃশ্য হয়তো খুবই স্বাভাবিক। অথচ আজকের পরিস্থিতিতে কেমন যেন চোখে জল এনে দেয়। আনন্দে অনেকটা বাতাস টেনে নিই বুকের ভিতর।

বেরিয়ে আসতে আসতে প্রার্থনা করি, এই কবরস্থান যেন চিরজীবী হয়। অন্তত এমন সুন্দর সম্প্রীতির ছবি যেখানে ধরা দেয়, তাকে কি মুছে ফেলা যায়?

Powered by Froala Editor