শতবর্ষ আগে ভিক্টোরিয়ার চূড়ায় নেমে এসেছিল পরী, ঘুরে-ঘুরে দেখত গোটা কলকাতা

এই পরীকে আমরা চিনি। কলকাতার একমাত্র ফেয়ারি টেল যাকে ঘিরে। প্রতিদিন তাকে দেখতে কত যে লোকের ভিড়। কলকাতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জুড়ে থাকা এই স্মৃতিচিহ্ন ও তার চূড়ার পরী। নয়-নয় করে একশো বছরে পা দিল তারা।

কলকাতার ময়দানের আকাশজুড়ে দুহাত বিছিয়ে আছে ভিক্টোরিয়া। তার উত্তুরে গেটে পাহারাদার দুটি সিংহ। রানির যোগ্য বাহন। আর গেট পেরোলেই সিংহাসনে বসে স্বয়ং ভারতসম্রাজ্ঞী।

ইতিহাসটি আমাদের মোটামুটি জানা। চেনা গল্প। ১৯০১ সালে রানিমা দেহ রাখলেন। সেদেশ জুড়ে অশ্রু ঝলমলো। কলকাতায় তখন লর্ড কার্জন। বাংলা ভাগের ফন্দি আঁটছেন। আরেকটা প্ল্যানও চট করে মাথায় খেলে গেল। রানির নামে স্মৃতিচিহ্ন বানানোর প্ল্যান। আর সমস্যাই বা কী? পয়সা এদেশের, শ্রম এদেশের, কাঁচা মাল এদেশের। নামিয়ে দাও একটা চমৎকার প্রাসাদ।

আরও পড়ুন
ফরাসি কোম্পানির গাড়ি থেকে হলুদ অ্যাম্বাসেডর – ১১১ বছর পেরিয়েও উজ্জ্বল কলকাতার ট্যাক্সি

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বানানো শুরু হয় ১৯০৬ সালে। শেষ হয় ১৯২০-তে। বেলফাস্ট সিটি হলের আদলের এই স্মৃতিচিহ্নটি। উইলিয়াম এমারসনের পরিকল্পনা। তবে এটুকুই নয়। কার্জনের প্রিয়তম স্থাপত্য তাজমহল। তারও ছোঁয়া যেন মিশে রয়েছে এখানে। ভিক্টোরিয়া তৈরি হয়েছিল মাকরানা মার্বল দিয়ে। সাদা এই পাথরেই নাকি তৈরি তাজমহলও। অগত্যা? আমাদের তাজমহল নেই, ভিক্টোরিয়া আছে।

আর আছে ভিক্টোরিয়ার মাথার ঘূর্ণায়মান পরী। জর্জ ম্যানসিনি নামের এক শিল্পীর নির্মাণ। প্রায় ৪ টনের এই ব্রোঞ্জ মূর্তিটি ইংল্যান্ডের শেলটেন্যাম থেকে পাড়ি দিয়েছিল ১৯২০ সালে। ভিক্টোরিয়ার চূড়ায় সে বসে ১৯২১-এ। কলকাতায় তখন হাওয়া খেলত প্রচুর। বলবেয়ারিং প্রযুক্তিতে পরীও ঘুরত বাতাসের তালে তাল মিলিয়ে। আর গুজব রটত। সে পরী আসলে নাকি ভারতসম্রাজ্ঞীরই প্রতীক। ঘুরে ঘুরে দেখছেন, কেমন আছে সাধের শহরটি। আজ আর সে হাওয়া নেই। ভিক্টোরিয়ার থেকেও উঁচু উঁচু অট্টালিকা হাওয়াদের পথ আটকে দাঁড়িয়েছে। ফলে পরীর ঘোরাঘুরি বন্ধ।

তবু ভিক্টোরিয়াকে ঘিরে আবেগের শেষ নেই। দর্শনার্থীদের ভিড়। সামনেই ঘোড়ার গাড়ির মহল্লা। ল্যান্ডো ব্যারুস ফিটন না হোক। টিনের চকচকে পাতেরই হোক নাহয়, ক্ষতি কী? হাড় জিরজিরে খচ্চর-ঘোড়াই একশো বছর ডিঙোতে সক্ষম। ভিক্টোরিয়ার বিপরীতে তারই বয়সি বসার চেয়ার। সিংহমুখো চেয়ার। জীর্ণ হয়েছে, রঙ চটেছে, দাগও ধরেছে বিস্তর। তবু এখনো আছে। মেমোরিয়াল-মুখী চেয়ারগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একগুচ্ছ অতীত নড়ে ওঠে। কলকাতাপ্রেমী কত না তরুণ সাহেব বিকেলের পড়ন্ত আলোয় এখানেই বসে চেয়েছিল সাদা সৌধটার দিকে। হয়তো আরেকবার গর্ব অনুভব করেছিল স্বদেশের কথা ভেবে। কিংবা প্রবাস-দুঃখ লাঘব করছিল। অথবা হতেই পারে, সদ্য আহত প্রেমিকপ্রবর একলা হওয়ার পথ খুঁজেছিল।

আরও পড়ুন
যেখানে ঘুমোচ্ছেন মধুসূদন, মৃতদেহে ছায়া দিচ্ছে পরী, কলকাতার হারানো অতীত ও এক কবরস্থান

কলকাতায় তখন জনবসতি এত ঘন নয়। আর গঙ্গাও তখন বেশ স্রোতস্বিনী। আজকের মতো হাঁপ ধরে ধরে চলে না সে। গাছগাছালি পাখির কুহুতান - দারুচিনি অরণ্যের ফাঁকে অপার নির্জনতা।

আজও ভিক্টোরিয়া ও ময়দান চত্বরই কলকাতার সবথেকে বেশি বৃক্ষময়। বড়ো গাছের নিবিড় ছায়াচিত্র দেখা যায় এখানে। দেখা যায় প্রেমিক-যুগলের নিভৃত আলাপচারিতা।

একটি গল্পের কথা খুব মনে পড়ে। দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'অশ্বমেধের ঘোড়া'। অমোঘ কিছু লাইন- "…আমরা অবসর খুঁজতাম, যেখানে নিবিড় হওয়া যায়। আমাদের জীবনে অবসর পাই না। আমরা একটা পরিমণ্ডল খুঁজতাম, যেখানে আমরাই অধীশ্বর। আমাদের সময় সে পরিমণ্ডল দেয় না।…"

কলকাতা থেকে মাঠ তো বিলুপ্তই। পাশাপাশি বসার জায়গাগুলো সেঁধিয়েছে ক্যাফেটেরিয়ার ঠান্ডা ঘরে। তবু এটুকু যদি থাকে… সেখানেও হয়তো প্রচুর ভিড়। তবু সামনের ইতিহাস, অয়েল পেইন্টিঙে বাঁধানো আদ্যিকালের কলকাতা, টলটলে দিঘিজলে তারই ছায়া, গাছ, ফুল, পাখি - কল্পনারা উড়ান দেয়। প্রেমে জোয়ার আসে।

একশো বছরের স্মৃতিসৌধ, একশো বছরের পরী যেন এই নিভৃতিই বিলোচ্ছে অকাতরে। কলকাতার প্রেমের ইতিহাস লেখা হলে মহারানি ভিক্টোরিয়ার অবদান তাতে কম থাকবে না।