মহিলাদের বুকে কান পেতেই হৃদস্পন্দন শোনা! শালীনতা বজায় রাখতে জন্ম স্টোথোস্কোপের

উনিশ শতকের শুরুর দিক। প্যারিসের জনপদ ফিয়ে হেঁটে চলেছেন এক চিকিৎসক। মাথা নিচু করে পেরিয়ে যাচ্ছেন প্যারিসে উচ্ছ্বল যাপনচিত্রকে। ভেতরে ভেতরে চলছে এক অবিরাম তোলপাড়। চিকিৎসা করতে গিয়েই কি তিনি পেরিয়ে যাচ্ছেন শ্লীলতার সীমারেখা? হৃদযন্ত্র বা ফুসফুস পরীক্ষা করতে মহিলার রোগীর বুকে কান পেতে শোনা, একপ্রকার হেনস্থাই তো। না, এভাবে হয় না। কিন্তু উপায়? চিকিৎসা ছাড়ার কথাও আগে বার বার ভেবেছেন তিনি। এমনকি কয়েকদিন যানওনি হাসপাতালে। কিন্তু রোগীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াও যে অমানবিকতার সমতুল্য। চিকিৎসক হিসাবে নিজের দায়িত্বকে এড়িয়ে যাওয়া।

চিকিৎসক রেনে লেনেকের প্রতিদিনের ঠিকানা প্যারিসের নেকার হাসপাতাল। ফ্রান্সের এই প্রাণকেন্দ্র নগরীতে বেশ নামডাক লেনেকের। সাধারণ জ্বর থেকে শুরু করে, যক্ষ্মার মতো যে কোনো দুরারোগ্য রোগেই শেষ ভরসা লেনেক। তিনি হাল ছাড়েন না কোনো মতেই। চেষ্টা চালিয়ে যান শেষ মুহূর্ত অবধি। আর সব থেকে বড়ো কথা হল সম্ভ্রান্ত থেকে শুরু করে হতদরিদ্র, যে কোনো রোগীই সমান তাঁর কাছে।

লেনেকের পাশ দিয়ে যেতে যেতেই দু’জন মানুষ স্মিত হেসে গেলেন। কৃতজ্ঞতা ভরে রয়েছে সেই হাসিতে। লেনেক সামান্য মুখ তুলে দেখলেন ফুটপাথে দুটো ছোট্ট বাচ্চা খেলা করছে। হাতে একটা লম্বা কার্ডবোর্ডের চোঙ। চোঙের একদিক একজনের কানের কাছে ঠেকিয়ে, আরেকদিকে তার ছোট্ট বন্ধু কথা বলছে কিছু একটা। প্রথম জন ঠিকরে উঠছে তাতে। তারপর হাসির রোল। ছোটবেলায় এমনভাবে অভিজ্ঞতা হয়েছে লেনেকেরও। কত আস্তে বলা কথাও কী ভীষণ জোরালো শোনায়, তা নতুন করে বলার কিছু নেই।

ছোটবেলার সেই স্মৃতিকেই যেন উসকে দিল বাচ্চা দুটো। মনে মনে খানিকটা হাসলেন লেনেক। প্যারিসের এই প্রাণোচ্ছ্বলতার জন্যই এত ভালো লাগে তাঁর এই শহরকে। খানিকটা এগিয়েই গিয়েছিলেন লেনেক। বিদ্যুৎগতিতে তাঁর মাথায় সঙ্গে সঙ্গে খেলে গেল বহুদিন ধরে তাঁকে অস্বস্তি দিয়ে চলা এক সমস্যার সমাধান। যদি তাঁর ধারণাই ঠিক হয়, তবে মহিলা রোগীদের আর হয়রান হতে হবে না। বাড়িতে ঢুকেই শুরু হল প্রতীক্ষার প্রহর গোনা। পরদিন হাসপাতালে গিয়ে এটা যে পরীক্ষা করে দেখতে হবে তাঁকে।

যেমনটা চেয়েছিলেন তেমনটাই হল। হাসপাতালে পরদিন হৃদরোগের সমস্যা নিয়ে হাজির হলেন এক স্থূলকায় তরুণী। লেনেক বসতে বললেন তাঁকে। তারপর টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিলেন ওষুধ লিখে দেওয়ার নোটবুকটা। রোল করে চোঙ বানিয়ে ধরলেন তরুণীর বুকে। চোঙের আরেকদিকে কান।

লেনেকের এই কাণ্ড কারখানা দেখে বিস্মিত তরুণী। তাঁর সঙ্গে আসা পরিবারের আত্মীয়রাও। তবে অন্যদিকে ততক্ষণে হাসির রেখে ফুটে উঠেছে লেনেকের ঠোঁটে। তিনি ততক্ষণে স্পষ্ট শুনতে পেয়ে গেছে হৃদপিণ্ডের একটানা বাজতে থাকা বাদ্যযন্ত্রের তাল। এবার শুধু তাঁকে এই নোটবুকের বদলে বানিয়ে ফেলতে হবে একটা চোঙ।

আরও পড়ুন
ভারতের প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী, স্বামীর মৃত্যুর দিনেও ভোলেননি ‘প্রফেশনালিজম’

তেমনটাই হল। ১৮১৬ সালে প্যারিসের নেকার হাসপাতালেই জন্ম নিল এক অদ্ভুত যন্ত্র। যার মাধ্যমে দূর থেকেই শোনা যাবে হৃদযন্ত্র কিংবা ফুসফুসের শব্দ। বলে দেওয়া যাবে রোগের কারণ। লেনেক নাম দিলেন ‘সিলিন্ডার’। আর এইভাবে শব্দ শোনার পদ্ধতিকে তিনি নাম দিলেন মিডিয়াম অসকাল্টেশন।

তবে এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের পরও বেশ সমস্যার মুখেই পড়তে হল তাঁকে। বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখলেন না তৎকালীন সমাজ, অন্য চিকিৎসকরাও। তবে বছর চারেকের মধ্যেই তাঁর এই পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়ল ইংল্যান্ড, জার্মানি, ইতালিতে। ধীরে ধীরে পেল জনপ্রিয়তা। পরে লেনেক নিজেও বেশ কিছু বদল করেছিলেন ‘সিলিন্ডার’-এর। এই আবিষ্কারের সাড়ে তিন দশক পর ১৮৫১ সালে আয়ারল্যান্ডে তৈরি হল আধুনিক স্টোথোস্কোপ। দিশা দেখিয়ে দিয়েছিলেন লেনেক। এবার আইরিশ চিকিৎসক আরথার লেয়ার্ড দু’কানে শোনার মতো করেই রূপ দিলেন যন্ত্রটিকে। 

তবে তাঁর আবিষ্কারের এই পরিণতি দেখে যেতে পারেননি লেনেক। ‘সিলিন্ডার’ আবিষ্কারের বছর দশেক পরেই মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। মাত্র ৪৫ বছর বয়সে। ১৮২৬ সালে। সারাদিন যক্ষ্মা রোগীদের নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে কখন নিজেই আক্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন মারণ ব্যাধিতে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে এই যক্ষ্মাই কেড়ে নিয়েছিল তাঁর মায়ের প্রাণও। তাই সমাপ্তি টানতে চেয়েছিলেন এই রোগের ইতিহাসে। তা আর সম্ভব হল না। কিন্তু বাকি চিকিৎসকদের জন্য লিপিবদ্ধ করে গেলেন যক্ষ্মার যাবতীয় লক্ষণ এবং উপসর্গের প্রকৃতি। কী ধরণের শব্দ শোনা গেলে বোঝা যাবে যক্ষ্মাকে, তাও দেখিয়ে গেলেন লেনেক। 

আরও পড়ুন
ওআরএস-কে এনে দিয়েছিলেন স্বীকৃতি, প্রয়াত কিংবদন্তি বাঙালি চিকিৎসক ডা. ধীমান বড়ুয়া

পাশাপাশি শবদেহের পার্শ্ব ব্যবচ্ছেদের পদ্ধতি এবং লিভার সিরোসিসের মতো রোগকেও সনাক্ত করে গেলেন তিনি। আজও লিভার সিরোসিসকে তাই বলা হয় ‘লেনেক সিরোসিস’। আর স্টোথোস্কোপ ছাড়া সত্যিই কি কোনো চিকিৎসকের চরিত্র ভেসে ওঠে আমাদের মনে? বোধ হয় না। দুই শতক পেরিয়ে এসেও আধুনিক চিকিৎসায় তাঁকে অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই আজও...

তথ্যসূত্রঃ

১. Rene Theophile Hyacinthe Laënnec (1781–1826): The Man Behind the Stethoscope - Ariel Roguin - NCBI

আরও পড়ুন
মনোনয়নের তালিকায় বাঙালি চিকিৎসকের নাম, আসতে চলেছে নোবেল?

২. উইকিপিডিয়া

৩. Stethoscope History  - Littmann

Powered by Froala Editor

More From Author See More