ইন্দ্রপ্রস্থের সিংহাসনে বসেছেন মহারাজ যুধিষ্ঠির। তাঁর রাজসূয় যজ্ঞ উপলক্ষে নানা প্রদেশ থেকে এসেছে নানা উপঢৌকন। অসমের উপত্যকা থেকে তেমনই প্রজারা নিয়ে এসেছেন তাল তাল সোনা। মহাভারতের সভাপর্বে রয়েছে এমনই বর্ণনা। কিন্তু অসম উপত্যকায় তো কোনো সোনার খনি নেই। তাহলে এত সোনা তাঁরা পেলেন কোথায়? মহাভারতকার উত্তর দেননি। কিন্তু পরবর্তী ইতিহাস ধরে রেখেছে অসমের সোনার উৎসের কাহিনি। খনি নয়, এই সোনা পাওয়া যায় নদী থেকে। সারা পৃথিবীতে অনেক নদীতেই সোনার রেণু ভেসে বেড়ায়। তবে ব্রহ্মপুত্র (Bramhaputra River) এবং তার উপনদীগুলিকে ঘিরে যে অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছিল একসময়, তা সত্যিই অবাক করে। আজও অসমের বহু মানুষের পদবি সোনোয়াল। এই পদবীর সঙ্গেও জড়িয়ে আছে সেই ইতিহাস। নদী থেকে সোনা ছেঁচে বের করতেন বলেই তাঁদের পদবি ছিল সোনোয়াল।
মহাভারতের বর্ণনার পর দীর্ঘদিন কোনো লিখিত সাহিত্যে অসম উপত্যকার সোনার কথা জানা যায় না। এরপর আবার মোঘল যুগে এসে পাওয়া যায় সেই একই বর্ণনা। সিহাবুদ্দিন তালিশ-এর লেখা ‘তারিখ ই আসাম’ গ্রন্থে ব্রহ্মপুত্রের বালিয়াড়ি অঞ্চলে সোনার রেণু খুঁজে পাওয়ার বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায়। ঔরঙ্গজেবের জীবনীগ্রন্থ আলমগিরনামাতেও নদীর জল থেকে সোনা সিঞ্চনের কথা জানা যায়। ফরাসি পর্যটক জঁ ব্যাপটাইস্ট ট্যাভার্নিয়ারের গ্রন্থেও একই বর্ণনা রয়েছে। ১৮২৬ সালে দুই ব্রিটিশ কর্মচারী ক্যাপটেন হ্যানে এবং ক্যাপটেন ডালটন তো রীতিমতো উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন এই বিষয়টি নিয়ে। এমনকি নদী থেকে সোনা নিষ্কাষণের এই পদ্ধতিকে বাণিজ্যিক স্তরে নিয়ে যেতেও উঠে পেরে লেগেছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তবে শেষ পর্যন্ত অসমের চা-এর ব্যবসাকেই বেশি লাভজনক মনে করেছিলেন তাঁরা। সোনার দিকে আর তেমন নজর দেওয়া হয়নি।
অরুণাচলপ্রদেশ হয়ে ভারতে প্রবেশের আগে চিনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘুরে আসে ব্রহ্মপুত্র। আর তার অববাহিকায় রয়েছে একাধিক সোনার খনি। সোনা তো শুধু খনিতে থাকে না, তার আশেপাশের পাথরের গায়েও লেগে থাকে সোনার রেণু। ব্রহ্মপুত্র তার গতিপথে এই সমস্ত সোনা সংগ্রহ করতে করতে আসে। আর তারপর এসে উজাড় করে দেয় তার নিম্ন অববাহিকায়, অর্থাৎ অসম উপত্যকায়। মূল ব্রহ্মপুত্র নদীতে অবশ্য জলের স্রোত বেশ খানিকটা বেশি। বরং সুবর্ণসিরি, বুড়িডিহি, ধানসিরি, দিয়ং, জোগোলো প্রভৃতি নদীতে সোনা পাওয়া যায় অনেক বেশি। তার মধ্যে জোগোলো নদীতে সোনার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।
ঠিক কবে থেকে অসমের মানুষ নদী থেকে সোনা নিষ্কাষণ শুরু করেছিলেন, তা নিয়ে অবশ্য বেশ বিতর্ক রয়েছে। তবে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অহমীয়দের আগমনের অনেক আগে থেকেই এই পদ্ধতি চলে আসছে, এই বিষয়ে সকলেই একমত। কারণ সোনা নিষ্কাষনের পদ্ধতির সঙ্গে সবচেয়ে গভীরভাবে জড়িত কাচারি সম্প্রদায়ের মানুষরা। অহমীয়দের পূর্বে তাঁরাই এই অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। এরপর অহমীয়রা রাজত্ব দখল করে। কাচারি সম্প্রদায়ের মানুষরা তখনও সোনা নিষ্কাশন করতে থাকেন। তবে সেই সোনার ওপর তাঁদের নিজেদের কোনো অধিকার ছিল না। সমস্ত সোনা জড়ো করা হত রাজকোষে। অহমীয় রাজারাই তাঁদের উপাধি দিয়েছিলেন, সোনোয়াল। আজ সেই রাজত্ব নেই। সোনা নিষ্কাষনের সেই রীতিও হারাতে বসেছে। তবে সোনোয়াল পদবির মানুষরা আজও সেই ইতিহাস বয়ে নিয়ে চলেছেন।
আরও পড়ুন
৮৫টি নদীর জল নিয়ে এশিয়ার প্রথম ‘জলের জাদুঘর’ বাংলাদেশে
সোনোয়ালরা বেশিরভাগই এখন আধুনিক নানা পেশার সঙ্গে যুক্ত। তবে কেউ কেউ আজও সোনা খোঁজার নেশা ছাড়তে পারেননি। তাঁরা আজও জানেন, কীভাবে নদীর জল থেকে সোনার রেণু উদ্ধার করতে হয়। আজও এক একজন সোনোয়াল দিনে প্রায় ২ গ্রাম পর্যন্ত সোনা সংগ্রহ করে আনেন। দিন ভালো থাকলে ৫ গ্রাম সোনাও পাওয়া যেতে পারে। তবে এই বিপুল পরিমাণ সোনা নিয়ে কোনো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নেই তাঁদের। রাষ্ট্রীয়ভাবেও কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। ভারতের জনজীবনে এমনই কত সম্পদ অবহেলায় পড়ে থাকে, তার খবর কে রাখে!
আরও পড়ুন
৫ মাসে ৫০০ টন প্লাস্টিক অপসারণ যমুনা নদী থেকে, সৌজন্যে ভারতীয় প্রযুক্তি
তথ্যসূত্রঃ
১. METALLURGY IN MEDIEVAL ASSAM, SWARNA LATA BARUAH, Indian History Congress 2016
২. Quest for Himalayan Gold: Need for reappraisal of Subansiri River prospect, Bashab N Mahanta and Hiruj Saikia, Indian Journal of Geosciences
আরও পড়ুন
লকডাউনে সুস্থ হয়ে উঠছে ব্রহ্মপুত্রও, দূষণমুক্ত নদীর ছবি প্রকাশ্যে
Powered by Froala Editor