বন্ধ না-ও হতে পারে ফেভারিট কেবিন, দীর্ঘ ইতিহাস ও শঙ্কিত ভবিষ্যৎ এখনও দোলাচলেই

'দোকানের মালিক চাটগেঁয়ে ভদ্রলোক, নাম যত দূর মনে পড়ে, নতুনবাবু সুজন সুলভ স্নিগ্ধতায় আপ্যায়ন করতেন সবাইকে। সে সংবর্ধনা এত উদার ছিল যে চা বহুক্ষণ শেষ হয়ে গেলেও কোনো সংকেতে সে যতিচিহ্ন আঁকত না। যতক্ষণ খুশি আড্ডা চালিয়ে যাও জোর গলায়।…'

'কল্লোল যুগ' বইতে এই কথাগুলো লিখেছিলেন অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত। বলেছিলেন, 'ফেভারিট' না থাকলে কল্লোল সম্পূর্ণ হত না। শুধু তো কল্লোল যুগ নয়, শতবর্ষ পেরিয়ে আসা ইতিহাসে ফেভারিট ধরে রেখেছে অসংখ্য উত্তাল সময়ের স্মৃতি। কখনও একাকী শিবরাম চক্কোত্তি  সময় কাটিয়ে গিয়েছেন, কখনও এই কেবিনের কোনো টেবিলে বসে নজরুলের গলায় গান শুনেছেন সুভাষচন্দ্র। তখনও তিনি নেতাজি হয়ে ওঠেননি। তবে সেই সবই এখন কেবল স্মৃতি। কলকাতার বুকে নাকি আর কোনো নতুন তত্ত্ব বা তর্কের জন্ম দেবে না ফেভারিট কেবিন। তার দরজা নাকি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চিরকালের জন্য।

সকাল থেকে এই আশঙ্কাই ঘুরছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। যাঁদের ওই অঞ্চলে নিত্য যাতায়াত, এবং যাঁরা ফেভারিট কেবিনের ‘ভক্ত’, হাহাকার শোনা যাচ্ছে তাঁদের গলায়। কিন্তু কেন দেখা দিল এই সম্ভাবনা? কারণ সহজেই অনুমেয়। শোনা যাচ্ছে, দীর্ঘ লকডাউন ও আর্থিক টানাপোড়েনের পর, আর দোকান চালাতে চাইছেন না শরিকদের একাংশ। প্রকৃত ঘটনাটি কী?

খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছিল প্রহর। বিশ্বস্ত সূত্রে যা জানা গেল, তা প্রকৃত প্রচারের থেকে খানিকটা বিপরীতই। বর্তমানে ফেভারিট কেবিনের তিন শরিক। তার মধ্যে কেউ-কেউ দোকানটি বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষপাতী। কিন্তু একজন আবার বজায় রাখতে চান ঐতিহ্য। এখনও পাকাপাকি কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ফলে, বন্ধ না-ও হতে পারে ফেভারিট কেবিন। আর্থিক দৈন্যই যখন মূল সমস্যা, তা কাটিয়ে উঠলে আবার স্বমহিমায় ফিরে আসতে পারে সেটি।শরিকদের মধ্যেকার বোঝাপড়ার ওপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে ফেভারিট কেবিনের ভবিষ্যৎ। এছাড়াও, লকডাউন শেষে বইপাড়া স্বাভাবিক হলে আবার খুলবে কেবিনটি - শোনা যাচ্ছে এমন আশার কথাও।

এই দোলাচলে অনেকেরই মনে পড়ে যাচ্ছে শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাসের কথা। এই ইতিহাস বলতে গেলে আসলে কলকাতার সাহিত্য-রাজনীতি-শিল্পজগতের ইতিহাসের অর্ধেকটাই বলে যেতে হয়। কলেজ পাড়ার এই জায়গাই হয়তো তার জন্য বেশি করে দায়ী। একদিকে হ্যারিসন রোড (আজকের মহাত্মা গান্ধী রোড)-এর উপর প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউস, কাছেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ। আবার আছে হিন্দু হোস্টেল। আর এই গোটা এলাকার মাঝে একটা দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে ছিল ৬৯বি, সূর্য সেন স্ট্রিটের ফেভারিট কেবিন।

বন্ধ কেবিনের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলে মনে হবে হঠাৎ যেন একটা টাইম মেশিনে চড়ে ১০০ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে এসেছেন। সময়টা ১৯১৮ সাল। চট্টগ্রাম থেকে কলকাতায় এসে এই কেবিন তৈরি করলেন দুই ভাই নূতনচন্দ্র বড়ুয়া ও গৌর বড়ুয়া। মেনুতে যা ছিল, তা সেদিনের হিসাবেও খুব আহামরি কিছু নয়। দুধ চা ও লিকার চায়ের সঙ্গে পাওয়া যেত হার্ড টোস্ট, জেলি টোস্ট, কিছু বিস্কুট ইত্যাদি। ও হ্যাঁ, আর ছিল ফেভারিট কেবিনের দুই বিশেষ আকর্ষণ, পান কেক এবং টিপ বিস্কুট। চা খাওয়ার ফাঁকে মাঝে মাঝে পান কেকে কামড় অথবা প্লেটে রাখা টিপ বিস্কুট থেকে একটা দুটো মুখে না পু়রলে ঠিক মেজাজটা আসে না। এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও মেনুর তালিকা ছিল একইরকম। তিন-চার ঘণ্টা জমিয়ে আড্ডা দেওয়ার পরেও সব মিলিয়ে খরচ কুড়ি-পঁচিশ টাকার বেশি হত না।

এখানকার চায়ের দাম নিয়েই আছে আরেক গল্প। সেটা ১৯৭০ সাল। নকশাল এবং কৃত্তিবাসের যুগ। এমন সময় বাজারে চিনির দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে চায়ের দাম ২৫ পয়সা থেকে ৩০ পয়সা করার সিদ্ধান্ত নিলেন মালিকরা। আর তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে সংবাদপত্রে প্রতিবেদন লিখলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ফেভারিট কেবিনের চায়ের দাম বেড়ে গেলে তরুণ কবি এবং রাজনীতিকদের হবেটা কী? চায়ের দাম পাঁচ পয়সা বাড়ানো নিয়ে এমন সমস্যায় বোধহয় আর কাউকে পড়তে হয়নি।

এই কেবিনে বসেই কত সন্ধ্যা কাটিয়েছেন শক্তি-সুনীল। এসেছেন ঋত্বিক ঘটক, বিজন ভট্টাচার্য। অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের থেকে ৭০-এর দশকের আটটা-নটার সূর্যদের আশ্রয় দিতে বারবার পুলিশের জেরার মুখে পড়েছেন বড়ুয়া বিপ্লবীরা। সেই সবকিছুই অতীত নয়। প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিক্যাল কলেজের বুকে আজও যেসব পড়ুয়া নতুন দিনের নতুন রাজনৈতিক তত্ত্বের কথা ভাবার সাহস রাখে, তাদের আড্ডা-তর্ক-বিতর্কে লকডাউনের আগে পর্যন্তও জমজমাট হয়ে থাকত ফেভারিট কেবিন। আর চায়ের সঙ্গে চলত সিগারেট বা বিড়িতে সুখটান। হ্যাঁ, কলকাতার আর পাঁচটা কেবিন বা চায়ের দোকানে ধূমপান নিষিদ্ধ হয়ে গেলেও, ফেভারিট কেবিনে ধোঁয়া ওঠা বন্ধ হয়নি কোনোদিন। ঠিক যেমন বন্ধ হয়নি রান্নাঘরের পাশে নকশাল কর্মীদের পালিয়ে যাওয়ার সুড়ঙ্গটি। বছর দুয়েক আগে কেবিনের একশো বছরের একটু চুনকাম পড়েছিল শুধু। আর কিছুই বদলায়নি।

শুধু বদলে গিয়েছে সময়। এই সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তেই হল সমস্ত নস্টালজিয়াকে। টাইম-মেশিন তো কেবল কল্পনার বাহন। এই বিশ্বায়িত পৃথিবীতে টিকে থাকতে গেলে থাকতে হবে ঝাঁ চকচকে এয়ার কন্ডিশনে মোড়া ক্যাফেটেরিয়ার মধ্যেই। বিশ শতকের ঐতিহ্য এখন নেহাতই ব্রাত্য। 

তবে লড়াই এখন অন্য। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার। আর সেই লড়াইয়ে শরিক হতে চলেছেন নাগরিকদের একাংশই। একমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারে, কী হতে চলেছে ফেভারিট কেবিনের পরিণতি।

Powered by Froala Editor