হাটের মেজাজ প্রেসক্লাবে, মেঠো গন্ধ নিয়ে কলকাতায় হাজির ‘গ্রাম-কৃষ্টি উৎসব’

‘হাট বসেছে বুধবারে। ময়দানের কাছেই প্রেসক্লাব চত্বর। সেখানে বর্ধমান, বাঁকুড়া, মেদিনীপুরসহ বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছেন হস্তশিল্পীরা। ফেরি হচ্ছে পোড়ামাটি-ছৌ-এর মুখোশ, গ্রামীণ গয়না, জৈব ফসল, আচার, পাটের জিনিস নানা ধরনের গুড়সহ মাটির গন্ধমেশা হরেক পসরা। এসেছে নানা সমবায়, নানা স্বনির্ভর গোষ্ঠী তাদের হাতের কাজ নিয়ে। কিনছেন শহরবাসী। ২৩ ডিসেম্বর থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলছে এই গ্রাম-কৃষ্টির এই উদযাপন। যার নাম ‘গ্রাম-কৃষ্টি উৎসব’ (Gram Krishti Utsav) আয়োজনে কলকাতা ‘প্রেস ক্লাব’ (Kolkata Press Club)।

খানিক দূর এগোলেই দেখা যাবে মাচাবেঁধে চলছে গম্ভীরা পালা। অনেকেই তাল ঠুকছেন ভাওয়াইয়া, নাটুয়ার সুরে। এ যেন ধুলোধোঁয়াভরা শহরের বুকে পল্লীসংস্কৃতির একটুকরো ছবি। 

শীতকালে শহরজুড়ে ছোটোবড়ো মেলা বসে। প্রশ্ন উঠতে পারে, সেইসব মেলার তুলনায় এই ‘গ্রাম-কৃষ্টি উৎসবের' পার্থক্য কোথায়? হয়তো বাংলা সাংবাদিকতার পীঠস্থান প্রেস-ক্লাবের মতো জায়গায় এইধরনের উদ্যোগ হয়তো গড়ে দেয় এই ফারাক। সাংবাদিকতার চোখ চিনতে শেখায় বাংলার কৃষ্টি। নাড়ির টান শহুরে বাঙালিকে খুঁজে নিতে বাধ্য করে গ্রামবাংলা। 

নয় নয় করে উৎসব ছ'বছরে পা দিল। কথা হচ্ছিল, এই উদ্যোগের উদ্যোক্তা কবি প্রসূন ভৌমিকের সঙ্গে। ২০১৭ সালে বঙ্গবাসী কলেজে আটপৌরে আয়োজন হিসেবেই পথ হাঁটা আরম্ভ করেছিল এই মেলা। পরে দক্ষিণ ও উত্তর দিনাজপুর, মালদাতেও অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘গ্রাম কৃষ্টি উৎসব'। পাশে ছিল কলকাতা প্রেস ক্লাব এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

‘আমার দীর্ঘদিনের ইচ্ছা, শহরকে গ্রামমুখী করে তোলার। যে পসরা-হস্তশিল্প বাংলার শিল্পীরা এখানে নিয়ে এসেছেন, তা তো আর মেশিনে তৈরি হয় না। কিন্তু আমরা চাইছি, মূলধারায় ঠাঁই হোক এই পসরার। চাইছি, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, মধ্যস্বত্বভোগীদের ডিঙিয়ে শিল্পীরা সরাসরি যেন পৌঁছে যান ক্রেতার কাছে। অর্থ ঢুকুক গ্রামে। শিল্পীরা যেন তাঁদের পেশা ছাড়তে বাধ্য যেন না হন। সেইসঙ্গে গ্রামবাংলার কৃষ্টির বৈচিত্র্য উজ্জ্বল হয়ে উঠুক।’ বলছিলেন প্রসূন।

বাংলার ডোকরাশিল্পীরা একসময় পেশা ছেড়ে ধরেছিলেন জন-মজুরি। সরকারের হস্তক্ষেপে তাঁরা আবার ফিরছেন পেশায়। ভাঙা কুঁড়ে ত্যাগ করে অনেকেই তুলতে পেরেছেন পাকা বাসা। এই উৎসবকেও একরকম তাঁদের ঘুরে দাঁড়ানোর উদযাপন বলা যেতে পারে।


বিভিন্ন গ্রামীণ উদ্যোগের মাঝে চোখ টানল ‘বাংলাপণ’। এই মেলায় তাঁরা প্রথমবার। বাংলার ঐতিহ্যশালী গুড়কে ফিরিয়ে আনছেন তাঁরা। নদিয়া বাঁকুড়া, সুন্দরবন থেকে আনা খাঁটি গুড়ের সম্ভার ক্রেতাকে টেনে আনছে বাংলাপণের স্টলে। বাংলাপণের মূল উদ্যোক্তা সুমিত দাস জানালেন যে, ইতিমধ্যেই বহু মানুষ সাড়া দিয়েছেন, নিয়েছেন গুড়। সুমিতরা চাইছেন, চিনির বদলে আবার গুড়ে ফিরুক বাঙালি। 

‘গ্রাম-কৃষ্টি উৎসব’ আর মাত্র এক দিন। ইতিমধ্যেই গতবারের তুলনায় এবারে বিক্রি সন্তোষজনক। শিল্পীদের মুখে খুশির ছাপ। খুশি ক্রেতারাও। পরের বছর আবার জমে উঠবে উৎসব। বাঙালি ফিরবেন শিকড়ের টানে।

Powered by Froala Editor