ফাঁসির দড়িতে বন্ধুত্ব আরও ঘন হয়েছিল বিপ্লবী ‘শায়র’ রামপ্রসাদ আর আসফাকউল্লাহ-র

‘জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে,

বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে।’

মৃত্যুর সময় একজনের বয়স ৩০, অন্যজনের ২৭। দুজনেই কবিতা লেখেন। ধর্মে হিন্দু হলেও একজনের ছদ্মনাম 'বিসমিল'। ছেলেবেলায় মৌলভীর কাছে উর্দু শিখেছিলেন। তারপর ভাষাটার প্রতি প্রেমে পড়ে যান। সেকালে 'শায়র' মহলে, তিনি নামজাদা । তাঁর কবিতার একাগ্র পাঠক অন্যজন। তিনিও লেখেন। শুধু উর্দু না। ইংরেজিতেও। ধীরে ধীরে তাঁদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব।

সালটা ১৯১৮। মনিপুর লুঠ কাণ্ডে-এ জড়িত রামপ্রসাদ বিসমিল পালাচ্ছেন। পেছন থেকে ছুটে আসছে পুলিশের গুলি। ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন যমুনা নদীতে। দেহ খুঁজে পায় না পুলিশ। ডুবসাঁতারে গা ঢাকা দিলেন তিনি। পুলিশ জানতে না পারলেও, বিপ্লবীদের কাছে খবর ছিল যে, বেঁচেবর্তেই রয়েছেন রামপ্রসাদ। সে খবর জানতেন আশফাক-উল্লাহ খান। তাঁর দাদার কাছে প্রায় সমবয়সী এই ছেলেটির কীর্তিকলাপ শুনেছিলেন তিনি। শুধু একবার চোখের দেখা দেখতে পারলে হত! সে সুযোগও মিলল একদিন। একটি গোপন বৈঠকে বসেছিল উর্দু শায়রির আসর। বিসমিল আর আশফাক-উল্লাহ একসঙ্গেই পাঠ করেছিলেন কবিতা। বর্ণমালার প্রতিটি অক্ষরে ভাগ করে নিয়েছিলেন ভালোবাসা।

চৌরিচৌরার ঘটনার পর, গান্ধীজি তুলে নিয়েছিলেন অসহযোগ আন্দোলন। ক্ষুব্ধ বিসমিল কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। গঠন করেন রিভোলিউশনারি পার্টি। তাঁকে অনুসরণ করেন আশফাক-উল্লাহ। মহাত্মার প্রতি দুজনেরই জন্মেছিল ঘোর অবিশ্বাস। অহিংস আন্দোলনের পথকে ভ্রান্ত ঘোষণা করে, বৃহত্তর সহিংস লড়াই-এর পথ খুঁজছিলেন দুজনে।

১৯২৫ সালে কাকোরি ট্রেন মামলায় অভিযুক্ত হলেন রামপ্রসাদ, আশফাক-উল্লাহ সহ প্রায় চল্লিশজন বিপ্লবী। রামপ্রসাদকে পাঠানো হল গোরখপুর জেল। আর আশফাক-উল্লাহ গেলেন ফয়জাবাদে। মামলা চলে আঠের মাস। কিন্ত শেষরক্ষা হয়নি।

আরও পড়ুন
৬৩ দিন অনশনের পর মৃত্যু বিপ্লবী যতীন দাসের, মরদেহ কাঁধে তুলে নিলেন সুভাষচন্দ্র

১৯শে ডিসেম্বর ১৯২৭। আশফাক-উল্লাহ চুম্বন করছিলেন ফাঁসির দড়িকে। রামপ্রসাদের দৃষ্টি উদাস। হয়তো বন্ধুর সঙ্গে শেষ দেখাটুকু করে বিদায় নিতে পারলে মন্দ হত না।

একজন ছিলেন আর্য সমাজের সঙ্গে যুক্ত গোঁড়া সনাতনী হিন্দু। অন্যজন পাঁচ-ওয়াক্ত নামাজ পড়া মুসলিম। কিন্ত একে অন্যের ধর্ম সম্পর্কে কেউ কোনোদিন উচ্চবাচ্য করেননি। পারস্পরিক শ্রদ্ধা বৈ তাঁদের মধ্যে আর তো কিছু ছিল না!

তবুও ব্রিটিশ সরকার দুজনের মধ্যে বপন করতে চেয়েছিলো সাম্প্রদায়িকতার বীজ। পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট তাদাসুক হুসেন ক্রমাগত আশফাক-উল্লাহের কানে বিষ ঢালতে থাকেন রামপ্রসাদের নামে। উত্তরে হেসেছিলেন আশফাক-উল্লাহ। বলেছিলেন, ‘সাহেব, আপনার চেয়ে বিসমিলকে আমি বেশি চিনি। এটুকু বুঝি যে, ইংরেজের পা চাটা কুকুর হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে রামপ্রসাদের ভারতবর্ষে মরে যাওয়া অনেক ভালো।’

আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথকে 'নিষিদ্ধ' বই উৎসর্গ বিপ্লবীর; কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল বিশ্বকবিকেও

দুজনে স্বপ্ন দেখেছিলেন নতুন এক দেশের। ধর্ম-জাত-বর্ণের ঊর্দ্ধে যে ভূখণ্ড মানুষের কথা বলবে। আজকের ভারতবর্ষকে দেখলে তাঁরা কী ভাবতেন কে জানে!

সূত্র : Towards Freedom : Historical Web Archive, The Print

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
সেলুলার জেলের ফলক থেকে 'উধাও' তিন শতাধিক বাঙালি বিপ্লবী? শীর্ষে সাভারকরের নাম