কলকাতাকে নাখোদা উপহার দিয়েও শহর ছাড়ছেন কুটচি মেমোনরা

উঁচু উঁচু বাড়িতে আকাশ ঢেকে ফেললেও এখনও বহু দূর থেকে দেখা যায় মসজিদের চূড়া। রবীন্দ্র সরণি আর জাকারিয়া স্ট্রিটের সংযোগস্থলে নাখোদা মসজিদ (Nakhoda Mosque) উত্তর কলকাতার একটা ল্যান্ডমার্কও বটে। দেখতে দেখতে প্রায় ১০০ বছর বয়স হতে চলল মসজিদটির। তবে এখনও তার আভিজাত্যে চিড় ধরেনি একটুও। শহর কলকাতার (Kolkata) সমস্ত ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছে নাখোদা মসজিদ এক গর্বের প্রতীক। কিন্তু তার ইতিহাসের সেই শুরুর দিনগুলোর কথা কতজনই বা মনে রেখেছেন? শুধু নামের মধ্যে সেই ইতিহাসের কিছুটা এখনও থেকে গিয়েছে।

ফারসি ভাষায় নাখোদা শব্দের অর্থ জাহাজের মূল নাবিক বা ক্যাপ্টেন। আর এই মসজিদ যাঁরা তৈরি করেছিলেন, তাঁরাও ছিলেন জাহাজের ব্যাপারী। ১৯২০-র দশকে সুদূর গুজরাটের ভুজ অঞ্চল থেকে কলকাতায় এসেছিলেন কুটচি মেমোনরা। ১৯২৬ সালে তাঁদের হাতেই তৈরি হয়েছিল এই মসজিদ। আজও যা শহর কলকাতার সবচেয়ে বড়ো মসজিদ। সেই মোঘল আমল থেকেই নানারকম ব্যবসায় সাফল্য অর্জন করেছেন কুটচি মেমোনরা। আর যেখানেই গিয়েছেন, সেখানেই তাঁদের কৃতিত্বের নানারকম চিহ্ন রেখে গিয়েছেন। কোথাও মসজিদ বানিয়েছেন, কোথাও গড়ে তুলেছেন মাদ্রাসা। কলকাতা শহরে তেমনই রয়েছে নাখোদা মসজিদ। তবে আজ আর জাহাজের ব্যবসা নেই। কলকাতা বন্দরের অবস্থাও শোচনীয়। চিৎপুর অঞ্চলে কুটচি মেমোনদের বাসও প্রায় নেই বললেই চলে। মাত্র শ-দুয়েক সদস্য আজও থেকে গিয়েছেন ইতিহাস আঁকড়ে।

ঊনবিংশ শতক থেকেই চিৎপুর অঞ্চলে বাস ছিল কলকাতার মুসলমান সম্প্রদায়ের। গ্রামবাংলার নানা প্রান্ত থেকে শহরে উঠে আসা মুসলমানরা যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন বিহার বা উত্তরপ্রদেশ থেকে কাজের সন্ধানে কলকাতায় আসা মুসলমানরাও। ১৮৮০ সাল নাগাদই এখানে তৈরি হয়েছিল কলকাতা শহরের সবচেয়ে বড়ো মসজিদ। যা ‘বড়ো মসজিদ’ নামেই পরিচিত ছিল। এই বড়ো মসজিদেই মৌলবিদের হাতে রাখি পরিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তবে আজকের নাখোদা মসজিদের কাছে সেই বড়ো মসজিদও ছিল রীতিমতো ছোটো।


আরও পড়ুন
ঢাকেশ্বরীর আদলে কলকাতায় অষ্টধাতুর দুর্গামূর্তি, এখনও চলছে সেই পুজো

১৯২৬ সালে কুটচি মেমোন সম্প্রদায়ের আবদার রহিম ওসমান ঠিক করলেন, কলকাতার বুকে এমন এক মসজিদ তৈরি করবেন যা নিয়ে সারা দেশে গর্ব করা যায়। তখনই সেই বড়ো মসজিদের জায়গায় শুরু হল নাখোদা মসজিদ তৈরির কাজ। প্রথমেই তৈরি হল মসজিদের প্রবেশদ্বার। সবুজ গ্রানাইট পাথরের তৈরি সেই দরজা দেখলে ফতেপুর সিক্রির বুলন্দ দরওয়াজার কথাই মনে পড়ে। আর মসজিদটির কাঠামোও গর্ব করার মতো। ১৫১ ফুট উঁচু দুটি মিনারের সঙ্গে রয়েছে আরও ২৫টি ছোটো মিনার। সেগুলির উচ্চতাও ১০০ ফুট থেকে ১১৭ ফুট পর্যন্ত। ১৯২৬ সালেই এই মসজিদ তৈরি করতে খরচ পড়েছিল ১৫ লক্ষ টাকা। আর তার পুরোটাই দিয়েছিলেন কুটচি মেমোন সম্প্রদায়ের মানুষরা।

আরও পড়ুন
কলকাতার বসে আজও ‘স্বাধীন পাশতুনিস্তান’-এর স্বপ্ন বোনেন সীমান্ত গান্ধীর পৌত্রী

কুটচি মেমোনরা বিশ্বাস করেন, তাঁরা ইসলাম ধর্মের কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে পড়েন না। আসলে এক সময় তাঁরা হিন্দু ছিলেন। পরে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কুটচিদের তৈরি সমস্ত মসজিদেই তাই ইসলামের সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষ প্রার্থনা করতে পারেন। নাখোদা মসজিদেও তাই। প্রতি শুক্রবার অন্তত ১ হাজার মানুষ নামাজ পড়তে আসেন এখানে। আর শহরে ঈদ উৎসবের শুরুও হয় এই নাখোদা মসজিদ থেকেই। আজও এই মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সমস্ত খরচই করে যাচ্ছেন কুটচিরা। তবে তাঁদের বেশিরভাগই আর কলকাতা শহরে থাকেন না।

আরও পড়ুন
প্রেমিকের অন্যত্র বিবাহ, ১৪ বছর অপেক্ষার শেষে কলকাতায় মিলন সুচারু-রামচন্দ্রের

১৯২৬ সালে যখন নাখোদা মসজিদ তৈরি হয়, তখন থেকেই কলকাতায় ছোটোবড়ো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গিয়েছে। পরবর্তী ৩ বছরে বেশ কয়েকটা বড়ো দাঙ্গার সাক্ষী ছিল কলকাতা। ১৯২৮ সালের দাঙ্গায় চিৎপুর অঞ্চলের বহু মানুষও আক্রান্ত হয়েছিলেন। ৩০-এর দশকের শেষদিকে বেশ কয়েক বছর দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হয়নি ঠিকই। তবে এর পরেই স্বাধীনতার ঠিক আগে এসে গেল ১৯৪৬ সালের সেই রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা। তাছারা জাহাজের ব্যবসাও ততদিনে ডুবতে বসেছে। এইসমস্ত কারণেই আর কলকাতায় থাকতে চাননি মেমোনরা। তবে সকলে ছেড়ে চলে যেতেও পারেননি। আসলে কলকাতায় থাকতে থাকতে যে তাঁরা নিজেদের জাতি পরিচয়ই ভুলতে বসেছেন অনেকে। সামান্য কিছু পারিবারিক নিয়ম বাদ দিলে এখন তাঁরাও কলকাতার মুসলমান সমাজেরই সদস্য। গুজরাটের স্মৃতি নিছকই যেন ফেলে আসা অতীত।

তথ্যসূত্রঃ The forgotten history of Kolkata’s Kutchi Memons who built the city’s Nakhoda Masjid, Mohammad Ibrar, The Indian Express

Powered by Froala Editor