স্বাধীন ভারতের প্রথম নির্বাচন কমিশনার এক বাঙালি; সামলেছেন সুদানের দায়িত্বও!

প্রতিটা রাস্তার নাম এক একটা ইতিহাস ধরে রাখে। প্রায় ভুলতে বসা কোনো ব্যক্তির ভূমিকা হঠাৎ মনে পড়ে যায় কোনো রাস্তার নাম দেখে। তবে সুদানের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ কোনো বাঙালির নামাঙ্কিত রাস্তা দেখলে চমকে উঠবেন নিশ্চই। যাঁর নামে এই দীর্ঘ রাস্তা, তিনি সুকুমার সেন। কে সুকুমার সেন? না সাহিত্য-সমালোচক, ঐতিহাসিক সুকুমার সেন নন। একই নামের আরেক কিংবদন্তিকে প্রায় ভুলেই গিয়েছি আমরা। এমনকি বর্তমানে যখন নির্বাচনী হিংসাকে ঘিরে বারবার কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, তখনও আলোচনার আড়ালেই থেকে যায় স্বাধীন ভারতের প্রথম নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেনের কথা।

ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ বলেছিলেন, গণিতের ছাত্র ছিলেন বলেই সুকুমার সেন নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে এমন জীবন্ত অঙ্কের হিসাবে দেখতে পেরেছিলেন। আর নিখুঁত গণনার সাহায্যে শেষ পর্যন্ত এক অসম্ভবকেই সম্ভব করে তুলেছিলেন। পরপর দুটি সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা করেছিলেন সুকুমার সেন। ১৯৫১-৫২ সালে ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৫৭ সালে দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচন। দেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৭ সালে। সংবিধানও তৈরি হয়ে গিয়েছে ১৯৫০ সালে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জওহারলাল নেহেরু চেয়েছিলেন, অবিলম্বে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হোক। তৈরি হোক প্রকৃত গণতন্ত্র।

কিন্তু এই বিরাট কর্মযজ্ঞের পরিচালনা করবেন কে? ব্রিটিশ সরকারের সিভিল সার্ভিস কর্মচারীদের নিয়েই তখন তৈরি হয়েছে ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস। কিন্তু তার সদস্যরা কেউই জানেন না কীভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে হয়। ব্রিটিশ ভারত শাসন আইন অনুযায়ী দুবার নির্বাচন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে ভোট দিয়েছেন শুধুই কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা। আর এক্ষেত্রে নির্বাচক দেশের আপামর জনসাধারণ। তৎকালিন সমীক্ষায় যার মধ্যে ৮২ শতাংশই অক্ষরপরিচয়হীন। তবে অসম্ভবকে সম্ভব করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন বাঙালি আইএএস সুকুমার সেন।

নেহেরু চেয়েছিলেন, রাজনৈতিক নেতারা কেউই নির্বাচন পরিচালনার বিষয়ে যুক্ত থাকবেন না। সেই কাজটা করবেন আমলারাই। সুকুমার সেন বাছাই করা আমলাদের নিয়ে তৈরি করলেন নিজের বাহিনী। প্রথম শুরু হল প্রতিটা রাজ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য সংগ্রহ এবং নির্বাচকদের তালিকা তৈরি করা। কিন্তু শুরুতেই সমস্যা দেখা গেল। ভারতের বহু মহিলা তখনও পরিবারের বাইরে নিজের নাম প্রকাশ করতে রাজি নন। তাঁদের কি তাহলে নির্বাচকের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে? সুকুমার সেন স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ না করলে কাউকে নির্বাচনী অধিকার দেওয়া যাবে না। তাঁর অনড় অবস্থানে সম্মত ছিলেন না নেহেরুও। তবে সুকুমার সেন হিসাব কষে দেখিয়ে দিলেন, পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি না হওয়া নির্বাচকের সংখ্যা অনেকটা বেশি হলেও মোট নির্বাচকের তুলনায় তাঁরা মাত্র ২.৮ শতাংশ। আজ না হোক কাল, তাঁরা নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করে এগিয়ে আসবেন। আর মহিলাদের পর্দা প্রথার বাইরে বের করে আনার এই কাজটাও শুরু হোক প্রথম সাধারণ নির্বাচনের মধ্যে দিয়েই।

আরও পড়ুন
উনিশ শতক, কলকাতার প্রথম পুরভোট ও ‘ঘোড়া কেনাবেচা’র গপ্প

প্রস্তুতি চলেছে এক বছর ধরে। কীভাবে নির্বাচন হবে, তার বিশদ ভিডিও তৈরি করিয়েছিলেন সুকুমার সেন। দেশের প্রতিটা নির্বাচন কেন্দ্রে পর্দা টাঙিয়ে সেই ভিডিও দেখানো হয়। এইসব প্রদর্শনীর সময় উপস্থিত থাকতেন খোদ মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন। ভারতের এমন কোনো রাজ্য ছিল না, যেখানে তিনি নিজে উপস্থিত থেকে মানুষকে নির্বাচনের প্রক্রিয়া বুঝিয়ে দেননি। সেইসঙ্গে ঢেলে সাজিয়েছিলেন প্রচার মাধ্যমকেও। যার সবচেয়ে বড়ো অংশই ছিল রেডিও। প্রায় ৬ মাস ধরে রেডিওর প্রতিটা চ্যানেলে নিয়মিত শোনা গিয়েছে নির্বাচন সংক্রান্ত প্রচার। তবে সেটা কোনো দলের প্রচার নয়। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব প্রচার।

৩৫ কোটি নির্বাচক। তাঁদের অনেকেই হয়তো নির্বাচনে অংশ নেবেন না। কিন্তু প্রত্যেকের সমান সুযোগ থাকা চাই। জনসংখ্যা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা মাথায় রেখেই তৈরি হল নির্বাচন কেন্দ্রের মানচিত্র। সারা দেশ জুড়ে যেন এক উৎসবের মেজাজ। লালকেল্লায় স্বাধীন ভারতের পতাকা তখনও সমস্ত ভারতবাসী দেখেননি। প্রথম সাধারণ নির্বাচনই এনে দিয়েছিল প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ। তবে দুটি সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা করেই ইস্তফা দিয়েছিলেন সুকুমার সেন। বুঝেছিলেন, এবার আমলা ব্যবস্থা প্রস্তুত। পরে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া সুদানের প্রথম নির্বাচনও পরিচালনা করেছিলেন সুকুমার সেন। প্রথম নির্বাচনের সাফল্যের স্বীকৃতি হিসাবে পেয়েছিলেন প্রথম পদ্মভূষণ পুরস্কার। 

আরও পড়ুন
দীর্ঘ লড়াই-এর পর স্বীকৃতি, এবার ভোট দেবেন সোনাগাছির যৌনকর্মীরাও

শেষ জীবনে ফিরে গিয়েছিলেন নিজের জন্মস্থান বর্ধমান শহরে। বর্ধমানের জমিদার রাজা উদয়চাঁদ আর মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে তখন তৈরি হয়েছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানকার প্রথম উপাচার্য হয়েছিলেন সুকুমার সেন। লন্ডন ইউনিভার্সিটির গণিতের গোল্ড মেডেলিস্ট ছাত্র সুকুমার সেন শেষ জীবনে আবারও ডুব দিয়েছিলেন অঙ্কের জটিল হিসাবে। ১৯৬৩ সালে মাত্র ৬৫ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন সুকুমার সেন। তবে যে মানুষটার পরিচয় হওয়া উচিৎ ছিল ভারতীয় গণতন্ত্রের হারকিউলিস হিসাবে, তাঁর নাম আজ অনেকেরই অজানা।

তথ্যসূত্রঃ
১. The biggest gamble in history, Ramachandra Guha, Telegraph
২. Election Commission of India

আরও পড়ুন
এশিয়ার একমাত্র ভোটের কালি তৈরির কারখানা ভারতেই!

Powered by Froala Editor

More From Author See More