দুর্গার সঙ্গে মর্ত্যে আসেন শিবও, দিন কাটান মেদিনীপুরের এই ‘শ্বশুরবাড়ি’-তে

রাত পোহালেই দশমী। আপামর বাঙালি সারাবছর ধরে যে সময়ের জন্য অপেক্ষা করে থাকে, তারও তো শেষ হয়! এই শেষ লগ্নে শুধু কলকাতাই নয়, মফঃস্বলও উদ্বেল হয়ে উঠেছে পুজোর আনন্দে। হাতে আর বেশি সময় নেই। আনন্দের সবটুকু উপভোগ করে নেওয়া যাক এবেলা...

এরই মধ্যে, দূরের কোনো প্রত্যন্ত গ্রামে গেলে আজও দেখা যায়, ঐতিহ্য মেনে আজও পূজিত হয়ে চলেছে প্রাচীন কোনো দুর্গাপূজা। এত সমৃদ্ধ ইতিহাস, যেন গায়ে একটু টোকা মরলেই ঝরে পড়ে হাজারো ঘটনার ঘনঘটা। প্রায়ই অবহেলা ও অযত্নের শিকার, তবু অভিমান নেই। বছরের পর বছর ধরে একইভাবে পালিত হয়ে আসছে পুজো।

এমনই এক উদাহরণ পশ্চিম মেদিনীপুরের হেটলাপাড়ার দূর্গাপূজা। মেদিনীপুর সদর থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে প্রায় ১৯ কিলোমিটার গেলে পড়ে আনন্দপুর বাসস্টপ। এখান থেকে টোটো করে গেলে শিলাবতীর উপনদী তমালনদীর পাড়ে একটা সবুজে ঘেরা নির্মল গ্রাম হেটলাপাড়া।

গ্রামের নাম এমন হওয়ার তাৎপর্য আছে বইকি! আশেপাশের সমস্ত গ্রামের মধ্যে এই গ্রামটি সমৃদ্ধশালী হওয়ায়, আশেপাশের গ্রামের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে এটি। তাই এখানে একটা হাট বসত। হাট থেকে হাটুয়া এবং সেখান থেকে অপভ্রংশ হয়ে হেটলা। এই হেটলাপাড়ায় মালেদের পূজা প্রায় ২০০-২৫০ বছরের পুরনো, যা এখনও সমান আড়ম্বরে পূজিত হয়।

মালেদের এক পূর্বপুরুষ হরিচরণ মাল মহাজনী কারবারি করতেন। এই মহাজনী কারবারির জন্য তিনি ইংরেজ আমলে একবার জেলে যান। জেলে থাকাকালীন তিনি মায়ের স্বপ্নাদেশ পান যে, তাঁর পুজো করলে সমস্ত অশুভ দশা কেটে যাবে। জেল থেকে বেরিয়ে মায়ের স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী শুরু মালেদের দুর্গাপুজো। রানী শিরোমণি, যিনি চুয়াড় বিদ্রোহে এক অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে এই পরিবারের এক যোগসূত্র আছে। তিনিই মালেদের কোনো বংশধরকে জায়গির আর সম্পত্তি দান করেছিলেন এবং দুর্গার মন্দিরের জন্য পুকুর কেটে দিয়েছিলেন। এই বংশের এক প্রজন্মে কোনো পুত্রসন্তান না থাকায় একমাত্র কন্যা মানকুমারীর সঙ্গে দে বংশের পূর্ণচন্দ্র দে’র বিবাহ হয়। সেই থেকে এই পূজা মালেদের হাত থেকে দে বংশের হাতে আসে এবং এখন এই দে বংশের বর্তমান প্রজন্মের বংশধররা এই পুজোর দেখভাল করেন। 

এই পুজোর বিশেষত্ব হচ্ছে, পুজোর তোড়জোড় শুরু হয় জন্মাষ্টমী থেকে। এদনে শিলাবতী নদীর উপনদী তমাল নদীর ধারে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে মাটিপূজা করা হয়৷ সেই মাটি দিয়ে প্রতিমা নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। প্রতিবছর প্রতিমা বিসর্জনের পর কাঠামো মন্দিরে রেখে দেওয়া হয়।

প্রাচীন এই পূজায় দুর্গা একচালার। তবে মহিষাসুরমর্দিনী নন তিনি। তিনি এখানে শিব-দুর্গা, অর্থাৎ দুর্গার সঙ্গে থাকেন শিবও। দেবী দশভূজা নন, বরং দু’হাতে সবকিছু আগলাচ্ছেন তিনি। এক হাতে পদ্ম, অন্য হাতে বরাভয়। একচালায় শিব-দুর্গা বসে আর বাকি ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে থাকেন। বাড়ির তরফ থেকে শিবকে দেওয়া হয় রুপোর বেলপাতা, ত্রিশূল ও সাপ। দুর্গাকে দেওয়া হয় রূপোর হার, সোনার হার, সোনার নথ ও নুপুর।

অষ্টমীর দিন সন্ধিপুজোর সময় প্রতিবছর দুর্গার হাত থেকে পদ্ম খসে পড়ে। দে পরিবার এটিকে দৈবী ঘটনা ভাবতেই পছন্দ করেন। এটিই এই পুজোর সবথেকে আকর্ষণীয় বিষয়।

দশমীর দিন সূর্যাস্তের আগে তমাল নদীতে দেবীর বিসর্জন দেওয়া হয়। বিসর্জন দেওয়ার সময় কোন ট্রলি বা ভ্যান নয়, তিনটি বাঁশের উপর কাঁধে করে দেবীকে নিয়ে যাওয়া হয়। এই কাজটি আদিকাল থেকেই বংশপরম্পরায় পাশের মাঝিপাড়ার লোকজন করে আসছেন। প্রতিমার বিসর্জন না হওয়া পর্যন্ত এই এলাকার কোনো প্রতিমার বিসর্জন দেওয়া হয় না। কথিত আছে, নদীতে যখন প্রতিমা বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় প্রতিমার নিচ দিয়ে একবার গলে যেতে পারলে সমস্ত রোগ সেরে যায়।

এভাবেই বছরের পর বছর ধরে মিথ, ঐতিহ্য আর সংস্কার মেনে পালিত হয়ে আসছে পশ্চিম মেদিনীপুরের এই গ্রামের পুজো। শুধু মাল ও দে পরিবারই নন, বংশপরম্পরায় ঢাকী, পুরোহিতরাও যুক্ত এই পুজোর সঙ্গে। এভাবে শারদীয়াকে কেন্দ্র করে অভিন্ন হয়ে ওঠেন তাঁরা প্রতিবছর। দুর্গার সঙ্গে মর্ত্যে এসে, শিবও মিটিমিটি হাসেন দেখে। সার্থক এক একান্নবর্তী পরিবার যেন...