রামমোহনকে দুর্গাপুজোয় নিমন্ত্রণ দেবেন্দ্রনাথের, জবাব মনে রেখেছিলেন আজীবন

সাল ১৮২৬। রমাপ্রসাদ রায়ের হাত ধরে বড়ো বাগানবাড়িতে উপস্থিত হল এক শিশু। কতই বা বয়স হবে, আট কি নয়। বাগানবাড়িটি যার তার নয়, স্বয়ং রাজা রামমোহন রায়ের। অবশ্য ওই শিশুর কাছে কে রামমোহন রায়, তিনি কী মাপের মানুষ, অত কিছু স্পষ্ট নয়। সে মনের আনন্দে বাগানে ঘুরে বেড়াতে লাগল, দোলনায় দোল খেতে লাগল। আস্তে আস্তে যখন বড়ো হল, সবকিছু জানতে শিখল, তখন রামমোহন রায় অন্যভাবে তার কাছে এলেন। বন্ধু-পুত্র বলে কথা, রামমোহনেরও অত্যন্ত কাছের মানুষ হয়ে উঠল সে। কালে কালে ঠাকুরবাড়ির এই ছেলেটি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান, মহীরুহ। হয়ে উঠেছিলেন সকলের মহর্ষি, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর…

দুজনেই ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিনিধিস্থানীয়। রাজা রামমোহন রায় তৈরি করেছিলেন একটি আদর্শের, একটি পথ চলার; আর সেটাকে বহন করে নিয়ে গেছেন দেবেন্দ্রনাথ। বাধা এসেছে অনেক, সবকিছু একা হাতে সামলেছেন তিনি। সেই প্রেরণা, সেই সাহসই তিনি পেয়েছিলেন রামমোহনের কাছ থেকে। বয়সে অনেক বড়ো, পিতা দ্বারকানাথের বন্ধু। কিন্তু মনোজগতে প্রবেশ করতে বেশি সময় লাগেনি।

নিজের জীবন আলোচনায় বারবার রামমোহনের প্রসঙ্গ এনেছেন মহর্ষি। তাঁর কাছে তিনি তখন ‘রাজা’। নিজেই বলছেন, “আমার ওপরে তাঁহার এক নিগুঢ় প্রভাব ছিল। আমি তখন বালক ছিলাম, সুতরাং তাঁহার সহিত কথোপকথনের সুযোগ ছিল না। কিন্তু আমার ওপরে তাঁহার মুখের এমন এক আকর্ষণ ছিল যে, আমি আর কাহারও মুখ দেখিয়া কখনও সেইরূপ আকৃষ্ট হই নাই।…” রামমোহনও যথেষ্ট স্নেহ করতেন বালক দেবেন্দ্রনাথকে। এই স্নেহের পরিমাণ অনেকটাই। যখনই কোথাও যেতেন, গাড়িতে সঙ্গী হত দেবেন্দ্রনাথ। বয়সের ব্যবধান ঘুচে কোথাও যেন পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠতেন। অনেকে অবাকও হয়ে যেতেন এসব দেখে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন রামমোহন কি তখনই বুঝতে পেরেছিলেন উত্তরসূরিকে?

তখনও ঠাকুরবাড়িতে পুজো-পার্বণের রেওয়াজ ছিল। দুর্গাপুজো তো প্রতিবছরই হত। তখনও ব্রাহ্ম ধর্মের প্রভাব ঢোকেনি সেখানে। দেবেন ঠাকুর নিতান্তই ছোটো। এরকমই একবার পুজোর নিমন্ত্রণের ভার পড়ল তাঁর ওপর। কাকে নিমন্ত্রণ করতে হবে? রামমোহন রায়কে। ঠাকুরদা অর্থাৎ রামমণি ঠাকুরের বার্তাবাহক হয়ে সেখানে গেলেন দেবেন্দ্রনাথ। অবশ্য ততদিনে দ্বারকানাথ ঠাকুরও বন্ধু রামমোহনের প্রভাবে একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী হয়েছিলেন। কিন্তু পুজো বন্ধ হয়নি।

যাই হোক, রাজা রামমোহনের বাড়ি গিয়ে প্রথামাফিক নিমন্ত্রণ জানালেন দেবেন্দ্রনাথ। শুনে রামমোহন প্রায় হতবাক। জবাবে একটাই কথা বেরিয়ে এল, “আমায় দুর্গাপূজায় নিমন্ত্রণ!” অবাক হওয়া স্বাভাবিক। কারণ রামমোহন রায় পৌত্তলিকতার প্রবল বিরোধী। এসব তিনি একদমই বিশ্বাস করেন না। তাহলে তাঁকেই নিমন্ত্রণ! পরে বুঝলেন, এ সব সামাজিক আচার। রাজা রামমোহন রায় সেই দুর্গাপুজোয় যাননি; বদলে তাঁর ছেলে রাধাপ্রসাদ গিয়েছিলেন। কিন্তু আজীবন ওই একটি কথা দেবেন্দ্রনাথকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। “আমায় দুর্গাপূজায় নিমন্ত্রণ!”…

একদম শেষের দিকে রাজা রামমোহন রায় যখন ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন, তখন সবাই এসেছিল দেখা করতে। দেবেন্দ্রনাথ তখনও বালকমাত্র, তাই তাঁকে আর আনা হয়নি। কিন্তু বাধ সাধলেন স্বয়ং রামমোহন। তিনি বললেন, দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা না করে তিনি দেশ ছাড়বেন না। শেষ পর্যন্ত দ্বারকানাথ ছেলেকে নিয়ে এলেন। দেবেন ঠাকুরের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বিদায় নেন তিনি। সেটাই ছিল দুজনের শেষ দেখা। ব্রিস্টলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রামমোহন। শেষের সেই করমর্দনও দেবেন্দ্রনাথ ভুলতে পারেননি কোনোদিন। তার অর্থ যে অনেক কিছু ছিল। হয়ত ভাবী উত্তরসূরিকে নিজের চোখে শেষবার দেখতে চেয়েছিলেন রামমোহন। ব্রাহ্ম সমাজের দায়িত্ব নেওয়ার পরও দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গী ছিল রামমোহন রায়ের দর্শন, তাঁর আদর্শ। কোনোদিনও ত্যাগ করেননি সেসব। ‘রাজা’ যে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন, তা তো মানতেই হবে…

Powered by Froala Editor

More From Author See More