দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে, বিরল প্রজাতির ধানের বীজ সংরক্ষণ করছেন এই বাঙালি

‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ এই দেশ। এদেশের মাঠে মাঠে ফলত সোনা। আর সেই ধানের বৈচিত্র্যও ছিল কত। সেইসব ধান এখন প্রায় খুঁজেই পাওয়া যায় না। সারা দেশে এখন ধানের চাষ হয় বড়োজোর ১০টি প্রজাতির। কোথায় গেল আমাদের সেইসব চিরাচরিত ধানের প্রজাতিগুলো? এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজতে চেয়েছিলেন দেবল দেব। সে আজ থেকে তিন দশক আগের ঘটনা। আইআইএসসি’র এই প্রাক্তনী তখন গবেষণার কাজ করছেন একটি অসরকারি প্রতিষ্ঠানে। গবেষণার সূত্রেই খেয়াল করলেন, মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই হারিয়ে গিয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার স্থানীয় প্রজাতি। সেই থেকে পথচলা শুরু। কখনও পায়ে হেঁটে তো কখনও বাসের ছাদে চেপে পৌঁছে যেতে লাগলেন বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। যেখানে এখনও পুরনো পদ্ধতিতে পুরনো প্রজাতির ধান চাষ হয়। ২৫ বছরে তিনি সংগ্রহ করেছেন ১৪২০টি বিরল প্রজাতির ধানের বীজ। আর সেইসব বীজ সংরক্ষণের জন্য তৈরি করেছেন একটি সিড ব্যাঙ্ক, ‘ব্রীহি’।

আরও পড়ুন
পুতুলের মধ‍্যে গাছের বীজ, সচেতনতা বাড়াচ্ছেন পুরুলিয়ার পুতুল নির্মাতারা

৬০-এর দশক, সদ্য স্বাধীনতা পেয়েছে ভারতবর্ষ। গ্রামে গ্রামে কৃষকদের সংগঠিত করে শুরু হয়েছে বিরাট কার্যক্রম। তার নাম ‘সবুজ বিপ্লব’। আর এই সবুজ বিপ্লবের ফলেই হারিয়ে গেল বেশিরভাগ প্রজাতি। কারণ উচ্চফলনশীল প্রজাতিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বাজারে টিকতে পারল না সেইসব প্রজাতি। কেউ মনেও করলেন না সেইসব প্রজাতির সংরক্ষণ দরকার। অথচ বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের সংরক্ষণের জন্য কিন্তু অনেক ব্যবস্থাই নেওয়া হয়। অবশেষে দেবলবাবু এগিয়ে এলেন ধানের বীজ সংরক্ষণে। বিরল সমস্ত বীজ সংগ্রহ করতে ছুটে গিয়েছেন ভিনরাজ্যেও। এদেশের ১২টি রাজ্যের বীজ আছে তাঁর ব্যাঙ্কে। এমনকি বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান থেকেও সংগ্রহ করেছেন বীজ।

আরও পড়ুন
বিদেশে গবেষণার চাকরি ছেড়ে জৈব খামারের উদ্ভাবক, শিকড়ের টানে ডা. হরি নাথ

তাঁর সংগ্রহ করা বীজ তুলে দিতে চেয়েছিলেন চুঁচুড়া রাইস রিসার্চ স্টেশনে। কিন্তু সেখানকার আধিকারিকদের বোঝাতেই পারলেন না তাঁর কাজের প্রয়োজনীয়তা। এরপর বহু সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দরজায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। কিন্তু প্রত্যেকেই তাঁর উপর বিরক্ত হয়েছেন। এরপর সমস্ত দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে, বুঝতে পারলেন দেবলবাবু। এভাবেই তৈরি হল একটি প্রতিষ্ঠান ‘বসুধা’। শুধু সিড ব্যাঙ্কই নয়, সেইসঙ্গে নিয়মগিরির পাহাড়তলে তৈরি করেছেন একটি ‘আদর্শ খামার’। বিনামূল্যে কৃষকদের হাতে ধানের বীজ তুলেও দেন। এভাবেই যদি বাঁচিয়ে রাখা যায় বিরল প্রজাতিগুলোকে!

আরও পড়ুন
বর্জ্য ফেলার জায়গা হয়ে উঠল অরণ্য, কলকাতার বুকে আশ্চর্য কীর্তি আইনজীবীর

বিজ্ঞানী থেকে ধানের সংরক্ষক, যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। বহু তিরস্কার, বহু অপমান সহ্য করতে হয়েছে। তবু হাল ছাড়েননি তিনি। এখনও বিশ্বাস করেন, মানুষ অবশ্যই এ-কাজের প্রয়োজনীয়তা বুঝবে। সেই দিনটা যদি খুব দেরি হয়ে যেত, তাহলে হয়তো আর কিছুই করার থাকত না। আর সেই সময়ের কথা ভেবেই সমস্ত প্রজাতির বীজ জমিয়ে রাখছেন দেবলবাবু, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে যাতে তুলে দিতে পারেন সেগুলো। নাহলে তো কবেই হারিয়ে যেত সব।

More From Author See More