হাজার বছরের পুরনো কঙ্কাল ছাপ ফেলেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও

চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগ। ১৯২৮ সালে এখানকার প্রাচীন এক দুর্গ থেকে উদ্ধার হয় দশম শতকের এক মানুষের দেহাবশেষ ও তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র। কে সেই ব্যক্তি, সেই নিয়ে আলাপ-আলোচনার অন্ত ছিল না কোনো। কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই সেই সুযোগের ব্যবহার করে সোভিয়েত রাশিয়া এবং জার্মান নাৎসিদের মধ্যে একে অন্যের মত এবং নীতি প্রচার করার কাজে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। আর এই সমস্যার মাঝে পড়ে পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে এক প্রত্নগবেষকের জীবনদিশা। কিন্তু কী ছিল এর পিছনের রহস্য?

প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি দল যখন সেই দেহাবশেষ খুঁজে পান, তখন তার সঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল দুটো ছুরি, একটি তরোয়াল, একটি কুঠার এবং একটি ঝুড়ি। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট দাবি করেছে সেই ব্যক্তির প্রাথমিক পরিচয় এবং তাঁকে ঘিরে ঘনীভূত রহস্য উদঘাটনের কথা। দাবি করেছে কীভাবে এই ব্যক্তি অবশেষে তাঁর শেষ সমাধিতে পৌঁছলেন, সেই বক্তব্যও। এবং এই রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে যে, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এই ব্যক্তিকে ঘিরে যেসব ঘটনাপ্রবাহ রচিত হয়েছিল, সেগুলি পুরোপুরি আদর্শগতভাবে পরিচালিত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লিপ্ত প্রধান বিরোধীদলগুলির দ্বারা।

জার্মানরা এই ঘটনার সম্পূর্ণ সুযোগ নিয়ে প্রচার করতে থাকে যে, এই দেহটি একজন তথাকথিত ভাইকিং বা প্রাচীন কোনো জার্মানের পূর্বপুরুষের

ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমের সূত্র অনুযায়ী, ১৯২০ সালে এই ব্যক্তির খুলিটি উদ্ধার করেন চেকোস্লোভাকিয়ার জাতীয় জাদুঘরের কর্মীরা। প্রাগ দুর্গের সবথেকে প্রাচীন অংশের খোঁজ করতে করতে হঠাৎই দুর্গের চত্বরে গবেষকেরা আবিষ্কার করেন এটি। প্রাসাদের একটি পুরনো সমাধিস্থলের কাছে অবস্থিত এই অঙ্গন চত্বরটি প্রায় ৮০০ থেকে ১০০০ বছরের পুরনো বলে গবেষকদের ধারণা।

সেই গবেষক দলের পক্ষে ইভান বর্কভস্কি যখন এই খুলিটি খুঁজে পান, সেই সময় চেকোস্লোভাকিয়া কেবলমাত্র ১০ বছরের স্বাধীন একটি দেশ। তার মতে, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ানদের হয়ে লড়তে লড়তে ক্লান্ত এই যুবক বর্তমান যেখানে ইউক্রেন অঞ্চল, সেখান থেকে চেকোস্লোভাকিয়ার এই অঞ্চলে পালিয়ে আসেন। কিন্তু নিজের এই ভাবনা তখন প্রকাশ করতে চাননি বর্কভস্কি। কিন্তু অচিরেই তাঁর এই ভাবনা ভুল বলে দেখা দেয়। রুশ এবং নাৎসিদের কার্যকলাপে তিতিবিরক্ত হয়ে ওঠেন তিনি।

১৯৩৯ সালে নাৎসিরা দখল করে নেয় চেকোস্লোভাকিয়া। তারপর যখনই তারা হাজার বছরের পুরনো এই দেহের সন্ধান পায়, তখনই বর্কভস্কিকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয় যে কেন তিনি এতদিন এই তথ্য পৃথিবীর সামনে আনেননি। সুযোগ-সন্ধানী জার্মানরা এই ঘটনার সম্পূর্ণ সুযোগ নিয়ে প্রচার করতে থাকে যে, এই দেহটি একজন তথাকথিত ভাইকিং বা প্রাচীন কোনো জার্মানের পূর্বপুরুষের। বহু আগেই যে এই দেশে পা রেখেছিল জার্মানদের পূর্বপুরুষেরা, এই ঘটনায় প্রতিফলিত হয় সেই সত্যই। অর্থাৎ চেকোস্লোভাকিয়ার উপর জার্মানদের বরাবরই অধিকার ছিল, এই দখলদারি রাজনীতির দাবার চাল হয়ে যায় হাজার বছরের পুরনো একটি মৃতদেহ! এই ব্যাপারে পরবর্তীকালে বর্কভস্কি মুখ খুলতে চাইলে, তাঁকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়।

ওই ব্যক্তির অস্ত্রশস্ত্রে যে ‘আগুনের চিহ্ন’ দেখা গিয়েছে, তা সেই সময় ভাইকিংদের জন্য খুব পরিচিত একটি নিদর্শন ছিল

যদিও পরবর্তীকালে নাৎসি শাসন শেষ হলেও, অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি বর্কভস্কির জন্য। ওই দেহাবশেষের আসল তথ্য সামনে আনতে চাইলে ‘অ-কমিউনিস্ট সুলভ’ আচরণের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনে রুশরা। কোনওমতে সেই সময় চেকোস্লোভাকিয়া ছেড়ে পালাতে সক্ষম হন তিনি।

এরপর ১৯৪৬ সালে নতুন করে এই প্রসঙ্গে একটি রিপোর্ট সামনে আনেন তিনি। এই রিপোর্টে ওই ব্যক্তিকে তিনি স্লোভাকিয়ার একটি উচ্চ-রাজবংশের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি বলে উল্লেখ করেন। যদিও পরবর্তীকালে সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণাতেও সামনে এসেছে একাধিক পরস্পরবিরোধী তথ্য। ওই ব্যক্তির অস্ত্রশস্ত্রে যে ‘আগুনের চিহ্ন’ দেখা গিয়েছে, তা সেই সময় ভাইকিংদের জন্য খুব পরিচিত একটি নিদর্শন ছিল। কিন্তু যে স্থান থেকে সেই অস্ত্রগুলো আনা হয়েছিল তা একদমই ভাইকিংদের থাকার মতো জায়গা ছিল না। ইউরোপের মধ্যযুগীয় ইতিহাস আরও বেশি করে গভীরে গিয়ে যাচাই করার জন্য এই আপাত সাধারণ ঘটনাটি একান্তই বাধ্য করে গবেষকদের। প্রাগ ক্যাসেলে পাওয়া ওই তরবারিটির সমতুল্য আর কোনো কিছুই ওই দুর্গে ব্যাপক খননকার্যের পরেও পাওয়া যায়নি। এই ‘ইউনিকনেস’-ই আরও ভবিষ্যৎ গবেষণার দিকে ঠেলে দিয়েছে গবেষকদের। হয়তো এই রহস্য পুরোপুরি উদ্ঘাটিত হলে, মধ্যযুগীয় ইউরোপের ইতিহাস মোড় নিতে পারে কোনো নতুন দিকে।

তবে একটি ব্যাপারে বিশেষ গবেষণা না করেও নিশ্চিত নিদান দিয়েছেন গবেষকেরা— মধ্যযুগে ব্যক্তিপরিচয় যেমন জটিল ব্যাপার ছিল, তা ততোধিক জটিল হয়ে পড়ে তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার কালেও; বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। যে জটিলতার অংশ হতে হয়েছিল হাজার বছরের মৃত কঙ্কালকেও।

More From Author See More