সংখ্যার খেলায় মজিয়েছেন বিশ্বকে, প্রয়াত সুদোকুর জনক মাকি কাজি

ছোট ছোট ৯টি খোপ নিয়ে তৈরি একটি ব্লক। আর এরকম ৯টি ব্লক নিয়ে তৈরি গোটা টেবিল। তার মধ্যে ১-৯ পর্যন্ত সংখ্যাগুলোকে নিয়ম মেনে বসাতেই মাথার ঘাম ছুটে যায়। সময়ও কাটে, মস্তিষ্কের ব্যায়ামও হয়। এই না হলে জাপানি খেলা! সারা পৃথিবী এখনও মজে আছে সুদোকুতে। শুধু সেই খেলার স্রষ্টা বিদায় নিলেন নীরবে। সোমবার জাপানের ধাঁধাঁ পত্রিকা নিকোলাই-এর তরফ থেকে একটি শোকবার্তায় জানানো হল সেই কথা। গত ১০ আগস্ট প্রয়াত হয়েছেন ক্যানসার আক্রান্ত মাকি কাজি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৬৯ বছর।

মাকি কাজি, যাঁর নামের সঙ্গে হয়তো অনেকেই পরিচিত নন। কারণ সুদোকুর আধুনিকতম রূপ আবিষ্কার করেও কোনোরকম ট্রেডমার্ক নিতে চাননি তিনি। শুধু চেয়েছিলেন, সারা পৃথিবীর মানুষ এই খেলার স্বাদ পাক। প্রকৃতপক্ষে সুদোকুর ইতিহাস বেশ ধোঁয়াশায় ঢাকা। কেউ বলেন সুইৎজ গণিতজ্ঞ অয়লারের হাত ধরে এই খেলার শুরু। আবার কারোর মতে এই খেলা বহু আগে চিনদেশ থেকে ভারত হয়ে আরবে পৌঁছেছিল। আরবদেশ থেকেই এই খেলার নমুনা সম্বন্ধে জেনেছিলেন অয়লার। তবে সে যাই হোক, এই সময়ে খেলাগুলি আদৌ এমন প্রাণ মাতানো ছিল না। বরং ফাঁকিবাজ পড়ুয়াদের শাস্তি দিতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হত এই ধাঁধার সমাধানের জন্য। আর তার এমন সুন্দর নামও ছিল না তখন। তাই আধুনিক সুদোকুর ‘গডফাদার’ অবশ্যই মাকি কাজি। আর তার যাত্রা শুরু হয় ১৯৮০-র দশকেই।

১৯৫১ সালে উত্তর জাপানের সাপ্পোরো শহরে জন্ম হয় কাজির। অঙ্কের প্রতি একটা ভালোবাসা ছিল ছোটো থেকেই। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে কেইও ইউনিভার্সিটির পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে দিলেন কাজি। কারণ কী? তিনি তৈরি করবেন সম্পূর্ণ নতুন ধারার এক ধাঁধাঁ পত্রিকা। জাপানে নানা ধরণের ধাঁধাঁর জনপ্রিয়তা বরাবরই বেশ বেশি। কিন্তু তাদের নিয়ে ধারাবাহিক পত্রিকা! কিন্তু কারোর কোনো কথাতেই কান দেননি কাজি। আর ১৯৮০ সালে এভাবেই প্রকাশিত হতে শুরু করল নিকোলাই পত্রিকা। কিন্তু পত্রিকা তার উপযুক্ত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না তখনও। কাজি বুঝলেন, এমন একটা খেলা লাগবে যা সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের।

নানা দেশের ধাঁধাঁ নিয়ে পড়াশোনা করতে করতে কাজি খুঁজে পান এই সংখ্যার খেলা। আর তারপর সেই খেলাকে সহজ করে নিয়ে নতুন নিয়ম তৈরি করেন। এবার এই খেলার একটা নাম দিতে হবে। কাজি নাম দিয়েছিলেন ‘সুজি-ওয়া-দকুসিন-নি-কাগিরু’। জাপানি ভাষায় যার অর্থ, প্রতিটি সংখ্যা একবার। কিন্তু সহকর্মীদের পছন্দ হল না এত বড়ো নাম। বেশ ছোট এবং মজার কোনো নাম দরকার। কাজি নিজেই বেছে নিলেন দুটো অক্ষর। খেলার নতুন নাম হয়ে গেল সুদোকু। দেখতে দেখতে নিকোলাই পত্রিকার জনপ্রিয়তাও বাড়তে লাগল। কিন্তু ২০০৪ সালের আগে জাপানের বাইরে সুদোকু নিয়ে তেমন উৎসাহ ছিল না। সেবছর দ্য টাইমস অফ লন্ডন পত্রিকায় একটি সুদোকু প্রকাশ পেতেই ইউরোপজুড়ে হইচই পড়ে যায়। দেখতে দেখতে এই খেলার কথা ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে। কাজি নিজেই সুদোকুর প্রচারের জন্য ঘুরেছেন ৩০টি দেশ। আর এখন প্রতি বছর শুধু সুদোকু প্রতিযোগিতাতেই অংশ নেন অন্তত ২০ কোটি মানুষ। ছোটো-বড়ো সকলেই। তবে এই প্রতিযোগিতাগুলি থেকে একটি টাকাও পেতেন না কাজি। কারণ তাঁর কোনো ট্রেডমার্কই ছিল না। মাকি কাজি বলতেন, সুদোকুর এই জনপ্রিয়তাই তাঁর পুরস্কার।

আরও পড়ুন
বনসাই দিয়েই তৈরি মিনি অরণ্য! জাপানের ‘ম্যাজিকাল টেকনিশিয়ান’ কিমুরা-র কীর্তি

স্বল্পায়ু জীবনেই সেই জনপ্রিয়তার চূড়া দেখে গেলেন কাজি। কিন্তু ততদিনে শরীরে বাসা বেঁধেছে ক্যানসার। অচল হয়ে পড়েছে খাদ্যনালী। দীর্ঘদিন শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করেও নিকোলাই পত্রিকার যাবতীয় দায়িত্ব সামলে গিয়েছেন তিনি। অবশেষে শেষ হল একটি অধ্যায়ের। মাকি কাজি চলে গেলেন, পড়ে রইল তাঁর ফেলে যাওয়া এক ধাঁধা। যার নাম সুদোকু। যাতে মুখ গুঁজে এখনও কয়েকটা প্রজন্ম কাটিয়ে দেবে নিশ্চিন্তে।

আরও পড়ুন
‘২১টি মুখওয়ালা রাক্ষস’-এর সন্ধানে ৪০ বছর ধরে ব্যর্থ জাপান পুলিশ

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
নিঃসঙ্গ মৃত্যুর ভয়ে আতঙ্কিত জাপানের ‘বাটারফ্লাই লেডি’