সৎসাহস নাকি খ্যাতির মোহ? বলিউডের অনিবার্য অস্বস্তি কঙ্গনা ও একটি ‘সুখী’ দেশের গল্প

একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য। তাতেই সর্বভারতীয় সমস্ত সংবাদমাধ্যমে এখন প্রথম সারির চর্চার বিষয় বলিউড অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাওয়াত। যে পেশার জন্য এত নামডাক, সেই পেশার সঙ্গেই জড়িত একের পর এক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে লাগাতার কামান দেগেই চলেছেন তিনি। কখনো কাস্টিং কাউচ, কখনো ‘সমস্ত বলিউড মাদকাসক্ত’ এমনই সব বিতর্কিত মন্তব্য শোনা গিয়েছে সাম্প্রতিককালে কঙ্গনা রানাওয়াতের মুখে। সমস্ত বলিউডকেই নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন থাকার জন্য কাঠগড়ায় তুললেও, নেশায় জড়িত থাকার অভিযোগ এসেছে স্বয়ং কঙ্গনার বিরুদ্ধেও। প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, কঙ্গনার বর্তমান বক্তব্য দ্বিচারিতার শামিল কিনা?

একথা ঠিক যে একটি গণতান্ত্রিক দেশে নিজের মত প্রকাশের অধিকার আছে সকলেরই। সেই দিক থেকে দেখলে কঙ্গনাও নিজস্ব মত ব্যক্ত করতেই পারেন। কিন্তু যেভাবে অনুরাগ কাশ্যপ থেকে শুরু করে রণবীর কাপুর, পরিচালক অয়ন মুখার্জি কিংবা আরেক সিনিয়র অভিনেত্রী উর্মিলা মাতন্ডকরের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন তিনি বিভিন্ন বিষয়ে, তাতে এই কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, কোথায় থামতে হয় সেটা কি ভুলে গিয়েছেন কঙ্গনা?

যদিও নিজের পক্ষে কথা বলার মত মানুষজনকেও পাশে পেয়েছেন তিনি। একথা সত্যি যে, একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আচমকাই কেউ যদি মুখ খুলে ফেলেন, তাহলে প্রাথমিকভাবে অসংখ্য ঝড়-ঝাপটা ধেয়ে আসতেই থাকে তাঁর দিকে। সত্যিই যদি বলিউড মাদকের ভিড়ে সামিল হয়ে থাকে, তাহলে তার মুখোশটা টেনে খুলে ফেলার জন্য শিরদাঁড়ায় যথেষ্ট জোর থাকা প্রয়োজন। কিন্তু তার সঙ্গে অবশ্যম্ভাবীভাবে যেটা দরকার, সেটা হল উপযুক্ত তথ্য এবং প্রমাণ। তা না হলে, কোনো অভিযোগ মান্যতা পায় না কখনোই। সম্প্রতি কঙ্গনা ইস্যুতে যা হয়ে চলেছে প্রথম সারির বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে, তাতে মনে হচ্ছে যে দেশে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নেই। অথচ ছবিটা কিন্তু তার থেকে একদমই আলাদা।

ইন্দো-চিন বর্ডারে পরিস্থিতি যথেষ্ট উত্তপ্ত। কোন পথে এগোচ্ছে সামগ্রিক পরিস্থিতি, তা নিয়ে এখনও নির্দিষ্ট কোনও তথ্য দিতে পারেনি কেন্দ্রীয় সরকার। দেশের আর্থিক অবস্থা যে লকডাউনের মধ্যে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাও হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে সাধারণ মানুষ। বিগত চার মাসে কর্মহীন হয়েছেন ৬০ লক্ষ ভারতীয়। সংসদে সরকার রীতিমত জোর গলায় জানিয়েছে যে, পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুর কোনও তথ্য তাদের কাছে নেই; সেই কারণে মৃত পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও কোনও প্রশ্নই ওঠে না বলে জানিয়েছে সরকার। শিক্ষাব্যবস্থাও প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে একের পর এক ঘটনায়। রীতিমতো নিজের জেদ বজায় রেখেই করোনা ভাইরাস আবহের মধ্যেই বিভিন্ন সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষা নিতে অনড় থেকেছে কেন্দ্রীয় সরকার। অভূতপূর্বভাবে সদ্য পার হওয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্মদিনকে দেশজুড়ে যুব সম্প্রদায় বেছে নিয়েছে জাতীয় বেকারত্ব দিবস হিসেবে। জন্মদিনের ‘রিটার্ন গিফট’ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর থেকে চেয়ে নিয়েছে চাকরি। অথচ এইসব ইস্যু থেকে সম্পূর্ণ অন্য মেরুতে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর গুণগান গেয়ে কঙ্গনা জানিয়েছেন, তাঁর মতো প্রধানমন্ত্রী পেয়ে ধন্য হয়েছে ভারত।

তবে সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর থেকে যেভাবে কঙ্গনা মাদক ইস্যুতে একের পর এক তোপ দেগেছেন, তাকে সময়ে সময়ে বাড়াবাড়ি বলে মনে হওয়াও স্বাভাবিক। এমনকি আপত্তিজনক কিছু সত্যি ঘটনা জেনে ফেলাতেই সুশান্ত সিং রাজপুত খুন হয়েছেন বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। যদিও এই সকল বক্তব্যের পিছনে কখনোই যুক্তিগ্রাহ্য কোনও প্রমাণ কিন্তু দেখানো হয়নি। শুধু তাই নয়, কঙ্গনা জানিয়েছেন বলিউডে প্রবেশ করার পর থেকেই তিনি নিজের চোখে দেখেছেন কীভাবে বিভিন্ন নৈশ পার্টিতে মাদকদ্রব্যের ছড়াছড়ি চলে। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নারকোটিকস কন্ট্রোল ব্যুরোকে বলিউডের অন্দরমহলে প্রবেশ করে দেখতে বলেছিলেন কী ভীষণ ভাবে মাদকাসক্ত প্রথম সারির তারকারা। এমনকি বলিউড তারকাদের রক্ত পরীক্ষাও করা দরকার বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি।

তবে এটাও আশ্চর্যজনক যে কঙ্গনার এমন বক্তব্যের পরেও বলিউড অভিনেত্রী রবীনা ট্যান্ডন অথবা পরিচালক রাম গোপাল ভার্মার মতো কেউ কেউ এর বিরোধিতা করলেও প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, বাকি বলিউড কেন নিশ্চুপ এর বিরুদ্ধে? তাহলে কি কঙ্গনার বক্তব্যকে পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে করছে বলিউড? নাকি সবকিছু জেনে বুঝেও আমাদের কিছু হবে না, এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনোভাবে আক্রান্ত বলিউড তারকারা?

আরও পড়ুন
ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের আর্জি কেন্দ্রের, অপপ্রচার আটকানোর আড়ালে কি বিরোধীদের কণ্ঠরোধ?

তা সত্ত্বেও যেভাবে কঙ্গনার মতের বিরোধিতা করায় বলিউড অভিনেত্রী উর্মিলা মাতন্ডকরকে ‘সফট পর্ন ছবির তারকা’ বলে অভিহিত করেছেন কঙ্গনা, তাতে অবশ্যই সীমা লঙ্ঘন করেছেন তিনি। এমনকি বলিউড অভিনেতাদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের স্ত্রীদেরকেও এই বিষয়ে টেনে এনেছেন কঙ্গনা। অভিযোগ করেছেন বলিউড অভিনেতাদের স্ত্রীরাও নাকি আলাদা করে প্রস্তুত করেন ড্রাগ পার্টির। সম্প্রতি বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে এভাবে কাদা ছোড়াছুড়ির জন্য সংসদে সরব হয়েছিলেন বর্ষীয়ান অভিনেত্রী জয়া বচ্চন। বেশ কিছু খারাপ দিক থাকলেও যেভাবে অন্ধকার বৃত্তে সবাইকে টেনে এনে দেখানোর চেষ্টা করছেন কঙ্গনা, তাতেই চটেছেন জয়া। প্রশ্ন করেছেন, যে থালাতে খাওয়া হচ্ছে সেখানেই থুতু ফেলা কতটা যুক্তিযুক্ত?

বিতর্ক আরও অন্য দিক থেকেও উঠে এসেছে কঙ্গনার দিকে। ড্রাগ নেওয়া স্বয়ং কঙ্গনার কাছেই ছিল জলভাত, এমনই মন্তব্য করেছেন কঙ্গনার প্রাক্তন প্রেমিক অধ্যয়ন সুমন। এমনকি কোকেন নেওয়ার জন্য অধ্যয়নকে একাধিকবার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন কঙ্গনা, তেমনই অভিযোগ করেছেন তিনি।

তবে নিজে ড্রাগ নেওয়ার কথা স্বীকার করলেও কঙ্গনা বলেছেন যে, খারাপ সঙ্গে পড়ে এই নেশায় জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। নেশায় আসক্ত হয়ে পড়লেও ধ্যান এবং যোগাসনের মধ্যে দিয়েই ক্রমে এই সমস্যা তিনি কাটিয়ে উঠেছেন। তবে এই সবকিছুর বাইরে কোথাও গিয়ে যেন বিষয়টা মিলছে সেই আকচা-আকচির রাজনীতিতেই। বিষয়টা যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজেপি সমর্থিত কঙ্গনা রানাওয়াতের বিরুদ্ধে বাকি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কথা চালাচালি। যেভাবে মহারাষ্ট্রের শাসক দল শিবসেনা অথবা কংগ্রেস প্রার্থী উর্মিলা মাতন্ডেকর জড়িয়ে গেছেন এর মধ্যে, তাতে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে অনেকটাই। এমনকি কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীকে সরাসরি আক্রমণ করার মধ্যে দিয়ে কঙ্গনাও অনেকটাই সামনে নিয়ে এসেছেন এই বিষয়টি। ইতিমধ্যেই মহারাষ্ট্র বিধানসভার দুই বিধায়ক কঙ্গনার বিরুদ্ধে ড্রাগের নেশায় জড়িত থাকার জন্য তদন্তের দাবি করেছেন।

আরও পড়ুন
লকডাউনে খাদের কিনারায় দলিত, মুসলিম এবং আদিবাসীরা, পৌঁছোয়নি ত্রাণও; প্রকাশ সমীক্ষায়

সুতরাং সব মিলিয়ে দেশের অন্যান্য চলমান সমস্যাগুলো থেকে অনেকটাই চোখ ঘুরিয়ে দিতে সফল হয়েছে কঙ্গনা ইস্যু। যেন এই একটিমাত্র সমস্যা ছাড়া বেশ সুখেই দিনাতিপাত করছে গোটা ভারতবাসী। তবে, মাদকের নেশা নিয়ে এত মতামতের ভিড়ে আসল সমস্যাগুলো যেন চাপা না পড়ে যায়, সেটাই এখন কাম্য। বেকারত্ব, জিডিপির পতন এবং দেশের আগামী অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ-- এসবই কিন্তু আমাদের সত্যিকারের ভালোথাকার ঠিকানা লিখবে। সেখানে কিছু বিতর্কিত বিনোদন জগতের মানুষদেরকে নিয়ে অত্যধিক মাতামাতির ফলে আদতেই কোনো কাজের কাজ আখেরে হবে কিনা, সেটা নিয়ে কিন্তু এবার সত্যি ভেবে দেখার সময় এসেছে। তার থেকেও বড়ো কথা, যেভাবে হ্যাশ কোকেন গাঁজা বা ড্রাগের মতো শব্দবন্ধ ঢুকে আসছে ড্রয়িংরুমের অভ্যন্তরে, তাতে ছোটোরা বড্ড বেশি ‘এক্সপোজ’ হয়ে যাচ্ছে না কি? আরেকটু সতর্কতার সঙ্গে কিন্তু ভাবা উচিৎ আমাদের।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
১৪ মাসে আত্মহত্যা ১৩ কর্মীর, ছাঁটাইয়ের পথে আরও ২০ হাজার; খাদের কিনারায় বিএসএনএল?

More From Author See More