সুস্থ বা প্রায় সুস্থতার পথে, করোনা ‘অসুখ’ সামলে আলোর দিশারী যে দেশগুলি

করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে, বিশ্বের অনেক দেশের ভুল পদক্ষেপের ফলেই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এই অতিমারী। সদ্যই এমন সতর্কবার্তা দিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রস অ্যাডানম গেব্রেয়েসুস। এই প্রসঙ্গে সদ্যই রাষ্ট্রপুঞ্জের সদর দপ্তর জেনিভায় একটি ভিডিও সম্মেলনে তিনি জানিয়েছেন যে, বিশ্বের একাধিক দেশেই করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত সুরক্ষার শর্ত অথবা সতর্কতা, কিছুই মেনে চলা হচ্ছে না। এর সঙ্গেই করোনা ভাইরাসের মোকাবিলা করতে ভুল পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে বেশ কিছু দেশ। অর্থাৎ অতিমারী নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক বিষয়গুলি অনুসরণ না করার ফলেই ভয়ংকর থেকে অতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে পরিস্থিতি। আমেরিকা, ব্রাজিল, ভারতের মতো দেশগুলিতে হুহু করে বেড়ে চলেছে আক্রান্তের সংখ্যা।

অথচ করোনা ভাইরাসের প্রাথমিক ঝড়ঝাপটা সামলে বর্তমানে ঘুরেও দাঁড়িয়েছে বেশ কিছু দেশ। ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা মহাদেশের সমস্ত এই সমস্ত দেশগুলির সুরক্ষা নীতিই হয়তো পারে এই অতিমারীর থেকে রক্ষা করে নতুন আলোর সন্ধান দিতে।

তাইওয়ান, ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, জার্মানি কিংবা আইসল্যান্ডের মতো দেশগুলি অত্যন্ত সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে করোনা মহামারী। পিছিয়ে থাকবে না বেলজিয়ামের মতো দেশও। দ্রুত উন্নতি করেছে ক্রোয়েশিয়া। পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হওয়ায় গ্রীষ্মকালীন পর্যটন শুরু করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে ইউরোপে। জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি খুলে দিয়েছে দেশের সীমান্ত। সুরক্ষা শর্ত বলতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যেন সামাল দেওয়া যায়, সেই জন্যই প্রস্তুত রাখা হচ্ছে যাবতীয় প্রস্তুতি।

ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরতে শুরু করার পর নিজেকে ‘গ্রিন জোন’ বলে চিহ্নিত করেছে ফ্রান্স। আর্থিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে না পারলে যে করোনা পরবর্তীকালে আরও খারাপ হবে দেশের সাধারণ জনগণের পরিস্থিতি, তা আন্দাজ করেই দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে অর্থনীতির হাল ফেরানোর। পর্যটনের পর সাধারণ সামাজিক দূরত্ব মেনে ফ্রান্সে চালু করে দেওয়া হয়েছে সমস্ত বার অথবা রেস্তোরাঁগুলি। যদিও এর সঙ্গে সঙ্গে চলেছে দেশবাসীকে সতর্ক করার কাজও। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাঁক্রো বারংবার নিজে জানিয়েছেন সতর্ক না হলে পুনরায় করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ এলে আবার বন্ধ করে দিতে হতে পারে সবকিছু; সুতরাং সতর্ক থাকার কোনো বিকল্প নেই। দেশকে স্বাভাবিক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেই সমস্ত পরিস্থিতির উপর কড়া নজর রাখছে জার্মান প্রশাসনও।

ঠিক কীভাবে সম্ভব হল এই অতিমারী ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করা? তাইওয়ানের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন সরকার প্রথম থেকেই প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো নিতে দেরি করেনি একটুও। যখনই গত বছর ডিসেম্বরে চিনে নতুন ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার কথা শোনা গিয়েছিল, তখনই উহান থেকে সমস্ত বিমানকে পরীক্ষা না করে দেশে ঢোকার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন তিনি। তারপরেই একটি মহামারী নিয়ন্ত্রণ সেন্টার তৈরি করা হয়, যাদের ব্যবস্থাপনায় তৈরি হয় মুখের মাস্ক ও ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক জিনিসপত্র। তার কিছু পরেই চিন, ম্যাকাও এবং হংকং থেকে আসা-যাওয়ার সমস্ত ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ফলে চিনের অত্যন্ত কাছে অবস্থিত হলেও, কখনোই তাইওয়ানে সেভাবে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা যায়নি।

কোভিড নিয়ন্ত্রণে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেলের ভূমিকাও অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৩৫ লক্ষ নমুনা পরীক্ষা করে প্রথমেই রোগীদের আলাদা করে ফেলে চিকিৎসা করার জন্য করোনা ভাইরাস সনাক্ত করা গিয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে এবং একটা সময়ের পরে সামাল দেওয়া গিয়েছে অতিমারীর ঝাপটা।

আরও পড়ুন
২০২১-এর আগে করোনার ১০০% কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কার অসম্ভব, দাবি ফরাসি বিজ্ঞানীর

শুধুমাত্র পর্যটনের উপরেই ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল নিউজিল্যান্ড। করোনা সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়েই সারাদেশব্যাপী লকডাউন জারি করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া এবং পর্যটন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ড প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন। ঘোষণা করেছিলেন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনাকাটি ছাড়া এবং স্বাস্থ্যগত একান্ত প্রয়োজন ছাড়া সমস্ত মানুষকে বাড়িতে থাকার জন্য। সারা দেশ জুড়ে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয় এবং প্রথমেই ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের আলাদা করে ফেলার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এমনকি ইস্টারের মতো উৎসবের সময়ও দেশ জুড়ে লকডাউন জারি রাখতে যে বক্তব্য রেখেছিলেন জাসিন্ডা, তা মন কেড়ে নিয়েছিল সকলের। দেশের ছোটদের উদ্দেশ্যে তিনি জানিয়েছিলেন, এই বছর ছোটোদের সঙ্গে দেখা করতে পারবে না ইস্টার বানিরা, কারণ তারা সবাই অসুস্থ মানুষদের সুস্থ করে তোলার জন্য একটা যুদ্ধে গিয়েছে!

ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন অথবা বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী সোফি উইলিয়ামস দেশের মানুষকে সচেতন করতে সামাজিক দূরত্ব এবং অন্যান্য বিষয় মেনে চলতে সম্পূর্ণভাবে কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিলেন। বেলজিয়ামে আক্রান্তের ৭০ শতাংশ বেশি মানুষ সুস্থ হয়ে উঠেছেন। ফিনল্যান্ড অত্যন্ত সংকটজনক অবস্থা কাটিয়ে উঠেছে প্রধানমন্ত্রী সানা মারিনের সুযোগ্য নেতৃত্বে। আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্যাটরিন জ্যাকোবসদ্দিয়ার কোথাও এক্ষেত্রে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। আইসল্যান্ডে প্রথম থেকেই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় করোনা ভাইরাস আক্রান্তকে আলাদা করে তাদের চিকিৎসা শুরু হয়েছিল। তার ফলে কখনোই সেভাবে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি সেখানে।

এছাড়াও আরও বহু দেশ সফলভাবে সামলেছে করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক, যার ফলে বর্তমানে সেইসব দেশের পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক। আফ্রিকার তিউনিসিয়া, চাঁদ, মরক্কো এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। করোনা ভাইরাস রুখতে বিশেষ সাফল্য পেয়েছে উরুগুয়েও। এশিয়া মহাদেশের কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান কিংবা ইউরোপের মন্টেনেগ্রো ছাড়াও ফিজি এবং অস্ট্রেলিয়াও দারুন ভাবে সামাল দিয়েছে করোনা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে সাবধানে থাকা আর সতর্ক থাকার থেকে আর বড় কোনও প্রতিষেধক নেই করোনা ভাইরাস সামলানোর জন্য। আশা করা যায় ভবিষ্যতে পৃথিবীর সমস্ত দেশই যদি এই উদাহরণ মেনে চলে, তাহলে হয়তো আরও বড় কোনও ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে পারে আমাদের মানবসভ্যতা।

আরও পড়ুন
নতুন ধরণের নিউমোনিয়া কি করোনার প্রভাবেই? কাজাখস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা

Powered by Froala Editor

More From Author See More