মহিলাদের পোশাক, পুরুষদের চাহনি

টোকিও অলিম্পিকে জার্মান মহিলা জিমন্যাস্ট এলিজাবেথ সেইটস বলেছেন, ‘আমরা মহিলারা ঠিক করব, কোন পোশাক পরব।’ কথাটা সমস্ত দেশের ক্ষেত্রে কেন প্রাসঙ্গিক? কেন আমাদের মতো দেশের ক্ষেত্রে আরও বেশি করে প্রযোজ্য? উত্তরপ্রদেশের একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। একটি ১৭ বছরের কিশোরী জিন্স পরেছিল বলে তাঁরই পরিবারের এক সদস্যের হাতে খুন হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও শ্রেণি, জাত, অঞ্চল বা ধর্ম নির্বিশেষে জিন্স একটি সর্বব্যাপী পোশাক হিসেবে মান্যতা পেয়ে গেছে অন্তত আমাদের দেশে, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই ধরনের একটি ঘটনা নিঃসন্দেহে আলোচনার দাবি রাখে। আজকের সময়ে দেশের কোথাও যদি মহিলাদের পোশাক পরা নিয়ে কোনও রকমের নীতি পুলিশেরা আসে, তাহলে কি করণীয়? আজ একুশ শতকে দাঁড়িয়েও যদি কোনো মহিলার কোনও পোশাক পরা নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে কি বলা উচিৎ হবে না, যে আমরা ক্রমশ পিছনের দিকে এগিয়ে চলেছি? 

ভারতীয় অর্থনীতির একটি কেন্দ্রীয় সূচক অনুসারে এমনিতেই কর্মজগতে মহিলাদের অংশগ্রহণ পুরুষদের তুলনায় যথেষ্ট নিম্নগামী। পুরুষদের ৭১ শতাংশের তুলনায় মহিলাদের মাত্র ১১ শতাংশ, তার মধ্যে যদি প্রতিনিয়ত একজন মহিলাকে এই রকম ধরনের বাধা নিষেধের সম্মুখীন হতে হয় তাহলে কি তাঁর পক্ষে এগোনো সম্ভব? জাতীয় অপরাধের যে সূচক নিয়মিত প্রকাশিত হয় তাতে দেখা গেছে যে মহিলাদের ওপর সবচেয়ে বেশি অত্যাচার করা হয় পরিবারের অন্যান্য পুরুষ সদস্যদের তরফ থেকে। এই অতিমারীর সময়ে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ এসেছে গাহর্স্থ্য হিংসার। বারবার করেই মনোরোগের চিকিৎসার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁরা বলেছেন যে এই লকডাউনের ফলে পরিবারের মধ্যে বেশ কিছু বিক্ষিপ্ত অশান্তি তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ভুক্তভোগী হয়েছেন মহিলারা। কাজের জায়গায় এমনিতেই নানান অসুবিধার মধ্যে আবার পোশাক সংক্রান্ত বিধিনিষেধ পরিবার থেকে শুরু হয়, তাহলে কি একজন মহিলার কাজ করার মানসিকতা থাকে? 

তাহলে কি এটা ধরে নিতে হবে এই একুশ শতকে এসেও পুরুষদের মানসিকতা এতটুকুও বদলায়নি, তাঁরা আজও মনে করেন যে মহিলাদের স্থান হওয়া উচিৎ গৃহকোণে? ঠিক যা বলা হয়েছিল মনুস্মৃতিতে তাই কি আজকের পুরুষেরা মেনে চলতে ভালোবাসেন? নাকি আরএসএস এবং সঙ্ঘ পরিবার দীর্ঘ প্রায় একশো বছর ধরে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যা সচেতন ভাবে প্রবেশ করিয়েছে তারই ফল দিচ্ছে এখন? এই যে গোরক্ষপুরের গীতা প্রেস যার বিভিন্ন বিপণী, দেশের বিভিন্ন রেলের প্ল্যাটফর্মে দেখতে পাওয়া যায় সেখান থেকে কম পয়সায় যে প্রচার পুস্তিকা বিক্রি হয় তার একেকটির মারাত্মক প্রভাব। তার মধ্যে একটি স্বামী রামসুখদাসের লেখা ‘কি করে গাহর্স্থ্য জীবন কাটাতে হবে’, যা দেশের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এই বইটির প্রতিটি অনুচ্ছেদে কীভাবে মহিলাদের দমিয়ে রাখা যায় তার উদাহরণ দেওয়া।  প্রশ্নোত্তরের সাহায্যে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে, গাহর্স্থ্য হিংসার সম্মুখীন হলে নারীদের কী করণীয়। যদি তাঁর স্বামী তাঁকে শারীরিক ভাবে নিগ্রহ করেন এবং তারপর যদি সেই নারী তাঁর মা-বাবার কাছে ফেরত যেতে চান এবং তখন যদি তাঁরা তাঁকে আশ্রয় না দেন, তাহলে কী করণীয়? শুধু তাই নয়, সতীদাহ প্রথাকেও আকর্ষণীয় করে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে এই ছোটো ছোটো নানান ভাষায় অনূদিত প্রচারমূলক বইগুলোতে।

আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে বিখ্যাত ইংরেজ প্রাবন্ধিক কবি জন বার্গারের একটি উক্তি নিয়ে আজও চর্চা হয়। ‘পুরুষেরা মহিলাদের দেখেন, আর মহিলারা নিজেদের শরীরের দিকে তাকান, তাঁদের দিকে তাকানো হয় সেটা দেখেন।’ এই ‘পুরুষদের চাহনি’ চলচ্চিত্র এবং ক্রীড়াজগতে বিশেষ করে উপলব্ধি করতে পারা যায়। এক্ষেত্রে মহিলাদের অবস্থা অনেকটা শাঁখের করাতের মতো, আসতেও কাটে, যেতেও কাটে। যদি তাঁরা নিজেদের সুবিধা মতো পোশাক পরেন, তাহলে এক ধরনের সমস্যা, আর যদি ফ্লোরেন্স গ্রিফিত জয়নারের মতো পোশাক পছন্দ করেন, তাহলে অন্য ধরনের সমস্যা। আশার কথা এটাই, যে ধীরে ধীরে এই মহিলা ক্রীড়াবিদদের কণ্ঠস্বর ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক স্তরের পাশাপাশি জাতীয় স্তরে, শুধু ক্রীড়াক্ষেত্রে নয় যেকোনো ক্ষেত্রেই মহিলাদের পোশাক নিয়ে আলোচনা আরও বেশি করে হলে কি ভালো নয়? যাঁরা, যে পোশাকে স্বচ্ছন্দ তাঁদের সেই পোশাক পরার কি স্বাধীনতা কি থাকা উচিৎ নয়?

আরও পড়ুন
গার্হস্থ্য হিংসা রুখতে পাঠ্যপুস্তকে বদল, মহিলাদের জন্য বিশেষ আদালতও গড়ছে কেরালা

আজকে যখন বাংলার তথা দেশের মহিলা ক্রীড়াবিদেরা দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন অলিম্পিকের মতো আন্তর্জাতিক মঞ্চে, যখন মীরাবাঈ চানুর মতো মহিলারা দেশের রূপকথা হয়ে উঠছেন তখন কি তাঁদের পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা উচিত? নাকি আজকে যাঁরা এই প্রশ্নগুলো করছেন, তাঁদের দিকেই উল্টে দেশের মহিলাদের একজোট হয়ে আঙুল তুলে ‘স্বাধীনতা’ ছিনিয়ে নেওয়া এখন সময়ের দাবি? যে মীরাবাঈ চানুকে নিয়ে নরেন্দ্র মোদী টুইট করছেন, সেই মণিপুরে কেন এখনো আফস্পা লাগু আছে, সেই প্রশ্ন দেশের সবার করা উচিত, না তাঁদের পোশাক নিয়ে চর্চা হওয়া বাঞ্ছনীয়?

অনেকে বলে থাকেন, কিছু মানুষ নাকি সমস্ত বিষয়ে রাজনীতি খোঁজেন। ক্রীড়া জগতে কেন রাজনীতি টেনে আনা হবে? কিন্তু রাজনীতি তো আছেই, থাকবেই। যখন দিলীপ ঘোষ বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে হাফ প্যান্ট পরা উচিত বলেন তার মধ্যে যেমন রাজনীতিও থাকে, মহিলাদের অপমানও থাকে আবার সম্পূর্ণ ক্রীড়াজগতকে হেয় করবার মানসিকতাও থাকে। উত্তরপ্রদেশের ঘটনা তখন আর বিচ্ছিন্ন থাকে না, কোথাও যেন মনুস্মৃতি সমস্ত কিছুর দখল নিতে চায়। কোথাও যেন আম্বেদকরের সংবিধানকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়। তখনই আবার ফিনিক্স পাখির মতো দেবাঙ্গনা কলিতা, নাতাশা নারওয়ালদের আবির্ভাব ঘটে, যাঁরা পুরুষতন্ত্রকে আবারো প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়ে ‘নিঃশর্ত স্বাধীনতা’র দাবিতে অর্ধেক আকাশের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। মীরাবাঈ চানুর ‘রূপোকথা’ আর উত্তরপ্রদেশের মেয়েটি কোথায় যেন এক হয়ে যান। তাঁদের প্রতিদিনের লড়াই ও যেন কোনো এক জায়গায় মিলে মিশে যায়।

আরও পড়ুন
চিকিৎসাতেও বৈষম্যের শিকার হন মহিলা রোগীরা, জানাল সাম্প্রতিক গবেষণা

(লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার। মতামত ব্যক্তিগত।)

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ব্রিটিশ রাজপরিবারের কঠোর নিয়ম, স্বাধীনতা নেই পোশাক নির্বাচনেও!

More From Author See More