অধিকারের দাবিতে একজোট ব্রাজিলের ৬০০০ আদিবাসী

ফেডারাল সুপ্রিম কোর্টের সামনেই এক টুকরো প্রশস্ত প্রাঙ্গণ। সেখানেই যেন আয়োজন হয়েছে মেলার। নানান রঙের তাঁবুতে ছেয়ে গেছে গোটা অঞ্চলটাই। ভিড় করেছেন হাজার হাজার মানুষ। তাঁদের কারোর গায়ে পাতার পোশাক, কারো মাথায় পালকের মুকুট, পিঠে তীর-ধনুক। সম্প্রতি এমন ছবিই দেখা গেল ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়ার বুকে। হ্যাঁ, তাঁরা প্রত্যেকেই ব্রাজিলের প্রাচীন জনগোষ্ঠীর সদস্য। আর এই জমায়েত নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার দাবিতেই।

বিগত তিন দশক ধরেই ব্রাজিলের বুকে অধিকার এবং স্বীকৃতির জন্য লড়াই করে আসছেন বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। সেই দাবিকে মান্যতা দিয়ে আদালতে মামলাও শুরু করেছিল ব্রাজিল সরকার। কিন্তু খাতায়-কলমে ব্রাজিলের আদি ভূমিপুত্রদের সমর্থন করলেও, বাস্তবে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে ব্রাজিল প্রশাসন। সেই মামলা ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরেই ফেঁসে রয়েছে লাল সুতোর ফাঁসে। পাশাপাশি দায়ের করা মামলার বয়ানেও রয়েছে যথেষ্ট খামতি।

মূলত, ফেডারাল আদালতে দায়ের করা সেই মামলায় বলা হয়েছিল, ১৯৮৮ সালের পর বাস্তুচ্যুত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষদের পুনর্বাসন এবং সংরক্ষণের জন্য আইনি পদক্ষেপ নেবে সরকার। তাঁদের প্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষার জন্যও নেওয়া হবে বিশেষ ব্যবস্থা। কিন্তু সেই নথি থেকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হন ১৯৮৮ সালের আগে উচ্ছেদের শিকার হওয়া জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। 

ইতিহাসের দলিল বলছে, ষোড়শ শতকের শুরুতে ব্রাজিল ঔপনিবেশিক রাজত্ব কায়েম হওয়ার পর থেকেই ক্রমশ হিংসার শিকার হয়ে আসছেন প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। পরবর্তীকালে রাবার চাষ ও শিল্পের প্রচলন আরও বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিল তাঁদের। শুধু বাসস্থান হারানোই নয়, একাধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে মুছে গিয়েছিল ব্রাজিলের বুক থেকে। এসব বাদ দিয়েও, বিশ শতকের কথাই বা বাদ দেওয়া যায় কীভাবে? ১৯৭০ সালে ব্রাজিলে মিলিটারি শাসনের সময়ও অকথ্য অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন তাঁরা। উন্নয়নের নামে ড্যাম এবং রাস্তা তৈরি জন্য লক্ষ লক্ষ আদিবাসীদের নির্বিচারে উচ্ছেদ করা হয়েছিল আমাজন থেকে। 

আরও পড়ুন
আমাজন কেটে দীর্ঘতম মহাসড়ক নির্মাণ ব্রাজিলে, অনুমোদন আদালতের

সরকার বদল হলেও সেই রীতিতে পরিবর্তন আসেনি কোনো। আরও এতটুকু কমেনি তাঁদের বিপন্নতা। বর্তমানেও সমানভাবে অত্যাচার চলছে আমাজনের ওপর। অবৈধ খনন, ঝুম চাষ, বৃক্ষচ্ছেদন চলছে গোটা ব্রাজিল জুড়েই। আর তাতে এককথায় যেন সায় দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট জের বলসোনারো। 

আরও পড়ুন
ব্রাজিলেই রয়েছে ‘বিশ্বের নিকৃষ্টতম ক্লাব’, যোগদানের প্রস্তাব গেল মেসির কাছে!

তবে ব্রাজিলের আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষেরা শতাব্দীপ্রাচীন এই শোষণের প্রতিবাদ করে এসেছেন ধারাবাহিকভাবেই। আমাজন, নিজের সংস্কৃতি বাঁচাতে কখনও কখনও প্রাণও দিতে হয়েছে তাঁদের। কিন্তু নিজের জন্মভূমি আঁকড়ে থেকে এই প্রতিবাদ যে আন্তর্জাতিক স্তরে সাড়া ফেলতে পারবে না, তা ভালোই বুঝেছিলেন তাঁরা। আর সেই কারণেই এবার প্রতিবাদের ক্ষেত্র হিসাবে তাঁরা বেছে নিয়েছেন খোদ রাজধানীর ফেডারাল সুপ্রিম কোর্টের প্রাঙ্গণকে। 

আরও পড়ুন
মৃত ৫ লাখ, নিষ্ক্রিয় প্রশাসন; কোপা আমেরিকার মধ্যেই বিক্ষোভ ব্রাজিলে

সম্প্রতি, সেখানেই জমায়েত হয়েছিলেন প্রায় ৬ হাজারেরও বেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সদস্যরা। অংশ নিয়েছিল ১৭৬টি জনগোষ্ঠী। লক্ষ্য, শহুরে ‘সভ্য’ মানুষদের অবগত করা তাঁদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির ব্যাপারে, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এবং নেতৃত্বদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। বিগত তিন দশকের সবথেকে বড়ো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জনসমাবেশ বলেই গণ্য করা হচ্ছে এই বিক্ষোভ অবস্থানকে। তাঁদের সেই উদ্দেশ্য ঠিক কতটা সফল হয়েছে, তা জানা নেই কারোরই, তবে বলসোনারো সরকারকে যেন পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল তাঁদের এই প্রতিবাদী অবস্থান…

Powered by Froala Editor

More From Author See More