এখনও ক্যামেরা ছাড়েননি বীরভূমের প্রথম প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার

সেটা ১৯৪৫ সাল। খুলনায় প্রসন্নকুমার দাসের কাছে ছবি তোলা শিখলেন তিনি। তারপর, মায়ের গয়না বিক্রি করে ৬০ টাকা দিয়ে কিনলেন ‘মিনিট ক্যামেরা’। কলকাতায় এসে যোগ দিলেন একটি স্টুডিও-য়। সেই শুরু। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি ‘ফটোগ্রাফার’ বিনয় গুহ-কে।

আজ তাঁর বয়স নব্বই। কিন্তু স্মৃতির ওপর থাবা বসায়নি বয়স। এখনও অনায়াসে ফিরে যান সেই দিনগুলিতে। বলেন, ‘মিনিট ক্যামেরা নিয়েই দু’বার গঙ্গাসাগর মেলায় গিয়ে বন্ধুদের ও অন্যান্যদের ছবি তুলে পরিচিতি পাই।  মনে আছে, স্বাধীনতার ঠিক আগে নেতাজির স্যাল্যুট দেওয়ার ছবির চাহিদা ছিল আকাশছোঁয়া। বি-২ সাইজের ১০০টা ছবি প্রিন্ট করে দিতে পারলে মিলত অতিরিক্ত ১ টাকা।  স্টুডিও-র বাইরে সেই কাজ করতে থাকি। আয়ের টাকা জমিয়ে ১৯৪৭ সালে ৬০০ টাকা দিয়ে কিনি আমার প্রথম প্লেট ক্যামেরা।’

১৯২৯ সালে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বরিশালের স্বরূপকাঠিতে জন্ম তাঁর। বাবা ছিলেন সরকারি চিকিৎসক। মাত্র ১১ বছর বয়সেই হারান বাবাকে। শুরু হয় সংসারে অনটন। পড়াশুনার ইতি ক্লাস নাইনেই। রোজগারের তাগিদে করেছেন সুপুরির ব্যবসা, বিস্কুটের দোকান, রেশনের দোকানে কাজ। তারপর, ৪৫ টাকা মাইনেতে যোগ দেন একটি চা কোম্পানিতে। সেই কাজের সূত্রেই পাড়ি দিতে হয় নাগপুর, রায়পুর ও আরও অনেক জায়গায়। প্রবাসেই তাঁর সঙ্গে আলাপ এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের। তিনিই ফটোগ্রাফি শেখার পরামর্শ দেন। তাঁর কথা শুনে ‘রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন বিনয়বাবু। খুলনায় ফিরে, সম্পর্কে দাদামশাই প্রসন্নকুমার দাসের কাছে নাড়া বাঁধেন। তারপরের জীবন রূপকথার মতো।

আরও পড়ুন
ফুটপাতের জীবন থেকে আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফার – পুরুলিয়ার ছেলের আশ্চর্য উড়ান

১৯৪৭ সালেই, সিউড়িতে মাসির বাড়িতে বেড়াতে আসেন বিনয়বাবু। এসে দেখেন, সিউড়িতে ফটোগ্রাফির কোনো স্টুডিও নেই। টিনবাজারে একটা দোতলা ঘর ভাড়া নিয়ে, স্টুডিও গড়েন তিনি। এবং পাকাপাকিভাবে চলে আসেন সিউড়িতে। তবে, প্রথমেই পসার জমেনি। কারণ, সিউড়ি বিদ্যুৎ আসেনি তখনও। মাঝে-মাঝে বাঁকুড়ায় গিয়ে গ্রামের ছবি তুলতেন। এরপর ১৯৪৯ সাল। বিদ্যুৎ এল সিউড়িতে। এনলার্জার কিনলেন বিনয়বাবু। শুরু হল সিউড়ি তথা বীরভূমের প্রথম প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারের পথ চলা...

ক্যামেরার প্রযুক্তি বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়েছেন তিনি। প্লেট ক্যামেরার পর এল  ১২০, ৩৫ ফিল্ম ক্যামেরা। রোলিফ্যাক্স, রোলিকট, ইয়াসিকা ৬৩৫-সহ একাধিক ক্যামেরা। ভাগ্যের সাহায্যও পেয়েছিলেন তিনি। নরওয়ে থেকে বক্রেশ্বরে গবেষণা করতে আসা এক সাহেবের লাইকা ক্যামেরার শাটারলক হয়েছিল। সময়টা ১৯৬০-৬১র দিকে। সাহেব বিনয়বাবুকে ক্যামেরাটা সারাতে দিয়েছিলেন। ডার্করুমে গিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতেই খুলে গিয়েছিল লক। আপ্লুত হয়ে পরে, তিনি বিনয়বাবুকে একাধিক ক্যামেরা, ফ্ল্যাস, এক্সপোজার মিটার উপহার দেন।

 ধীরে ধীরে ফোটোগ্রাফার হিসেবে সিউড়িতে নামডাক হচ্ছিল বিনয় গুহ-র। শহরের এমন কোনো বনেদি বাড়ি নেই, যেখানে তাঁর তোলা ছবি পাওয়া যাবে না। সত্তরের দশকের গোড়ায় জেলা প্রশাসন তাঁকে ‘পাবলিসিটি ফোটোগ্রাফারে’র মর্যাদা দেয়। ওই সময় ইন্দিরা গান্ধী, লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মতো বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির ছবি তুলেছিলেন। রঙিন ফিল্ম ও প্রিন্টের পরে যখন ডিজিটাল টেকনোলজি এল, সিউড়িতে বিনয়বাবু প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরা ও কম্পিউটার ব্যবহার করে পাসপোর্ট ছবি করা শুরু করেন।

আধুনিক যুগে নিকনের একটা ডিজিটাল ক্যামেরা কিনেছেন। ওটা দিয়ে মাঝেমধ্যেই ছবি তোলেন এখন। কিন্তু, প্রথম দিন থেকে সঙ্গী পুরনো ক্যামেরাগুলিই তাঁর প্রাণ। ২০০৪ সালে স্টুডিও যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু, নব্বই বছর বয়সেও ক্যামেরা ছাড়েননি সিউড়ি তথা বীরভূমের প্রথম প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার বিনয় গুহ।

কভারের ছবি - শাহিদ হোসেইন
অন্যান্য ছবি - লেখক

আরও পড়ুন
১২ বছর বয়সে ক্যামেরায় হাতেখড়ি; বাংলাদেশের প্রথম নারী ফটোগ্রাফার তিনি

More From Author See More