যে পদার্থ যত ফাঁপা, তার জলধারণ ক্ষমতাও তত বেশি। আর ঠিক সেই কারণেই দ্রুত জল শোষণ করতে পারে স্পঞ্জ। সাম্প্রতিক সময়ে গোটা বিশ্বজুড়েই বেড়েছে বন্যার প্রকোপ। এবার সেই বন্যা নিয়ন্ত্রণেরই অভিনব উপায় বাতলালেন চিনের (China) স্থপতি। তৈরি করলেন ‘স্পঞ্জ সিটি’ (Sponge City) নামের এক অভিনব শহরের নীল-নকশা। হ্যাঁ, নামকরণের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এই শহরের বিশেষত্ব। স্পঞ্জের টুকরোর মতোই বন্যার জল শুষে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে এই শহরের।
ইউ কংজিয়ান। কিশোর বয়সেই ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন চিনের এই স্থপতি। বন্যার জেরে হারাতে বসেছিলেন প্রাণও। আশির দশক সেটা। বন্যায় ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছিল হোয়াইট স্যান্ড ক্রিকের কয়েক হাজার একর জমি। জলস্তর বৃদ্ধির সঙ্গে ভূমিক্ষয়ে বাসস্থান হারিয়েছিলেন বহু মানুষ। সেই প্রাকৃতিক ভয়াবহতা তাঁকে তাড়া করে বেরিয়েছে বছরের পর বছর ধরে। বড়ো হয়ে তাই স্থাপত্যকেই পড়াশোনার বিষয় হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন কংজিয়ান। পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন বন্যা নিয়ন্ত্রণের বিশেষজ্ঞ।
তবে স্পঞ্জ সিটির পরিকল্পনা আজকের নয়। বেশ কয়েক বছর আগেই এই অভিনব শহরের ধারণা দিয়েছিলেন কংজিয়ান। এবার চিন-সহ আরও বেশ কিছু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশে শুরু হল তাঁর তৈরি নীল-নকশার আংশিক ব্যবহার। কিন্তু বন্যার বিরুদ্ধে কীভাবে সক্রিয়ভাবে কাজ করে এই স্পঞ্জ সিটি?
স্বাভাবিকভাবে বন্যা প্রতিরোধের পথ হিসাবে উঠে আসে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে প্রাচীর নির্মাণ কিংবা নদীর পাড় বাঁধাই-এর মতো সমাধান প্রকল্প। তবে কংজিয়ান বিষয়টি দেখছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে। বন্যা থেকে পরিত্রাণ নয়, বরং বন্যার সঙ্গে সহাবস্থানই এখন একমাত্র স্থায়ী সমধান। কংজিয়ান জানাচ্ছেন, জলবায়ু পরিবর্তনে আগামী দিনে ক্রমশ বাড়তে থাকবে বন্যার পরিমাণ। সেইসঙ্গে বাড়ছে সমুদ্রের জলতলও। ফলে, আজকের তৈরি কংক্রিটের তৈরি পরিকাঠামো আগামীদিনে কার্যকরী থাকবে আর সেভাবে। বদলে, কংজিয়ান উপস্থাপন করছেন বায়ো-সিঙ্কের পরিকল্পনা। সেটা ঠিক কীরকম?
প্রথমত গোটা শহর জুড়ে অসংখ্য ছোটো ছোটো অথচ, গভীর জলাধার তৈরি প্রস্তাব দিচ্ছেন কনজিয়াং। যেগুলি সিঙ্ক বা জলধারক হিসাবে কাজ করবে বন্যার সময়। ফলে নিকাশি ব্যবস্থার চাপ কমে যাবে অনেকটাই। কমবে প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা। দ্বিতীয়ত, গোটা শহর জুড়ে আঁকা-বাঁকা বেশ কিছু পরিখা বা খাল তৈরি ও তার দু’ধারে বৃক্ষরোপণের পরিকল্পনা করেছেন তিনি। যা বন্যার সময় কমিয়ে দেবে জলের গতিবেগ। নিয়ন্ত্রণে আনবে ভূমিক্ষয়কে। এই পরিকাঠামোকে আরও বেশি মজবুত করা যায়, মূল নদীর গতিপথে ও মোহনার কাছে কৃত্রিম হ্রদ তৈরির মাধ্যমে।
বন্যার বিরুদ্ধে ইউ কংজিয়ানের এই পরিকাঠামো সফলতা পেয়েছে ব্যাপকভাবে। সেইসঙ্গে তা পরিবেশবান্ধবও। তবে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অন্য একটি জায়গায়। বন্যার সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপও। বিধ্বংসী ঝড়ের সঙ্গে কংজিয়ানের এই শহর কতটা লড়াই করতে পারবে, তা নিয়ে এখনও রয়ে গেছে প্রশ্নচিহ্ন। ফলে, সেই মডেলকে সর্বজনীন বলা যাচ্ছে না এখনও। দেশের ভূপ্রকৃতি, অবস্থান এবং জলবায়ুর প্রকৃতির ওপর নির্ভর করেই ব্যবহার করতে হবে ‘স্পঞ্জ সিটি’-র পরিকল্পনা। কিন্তু তার পরেও এমন পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনার বিকল্প আর কীই বা হতে পারে?
Powered by Froala Editor