শব্দে-গন্ধে ঐতিহ্যের খোঁজ, অভিনব প্রদর্শনীর আয়োজন কলকাতায়

“ঐতিহ্য বাঁচানোর একটা প্রচেষ্টা সারা কলকাতা-জুড়ে দেখা যায়। সেটা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু ঐতিহ্য শুধুই বাড়ি-ঘর ও সংস্কৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তার বাইরেও কইছু ঐতিহ্য বেঁচে থাকে। সেই চলমান, বিবর্তনশীল ঐতিহ্যটা কলকাতার মতো শহরে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।” 

বলছিলেন ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ডক্টর ঋষিকা মুখোপাধ্যায়। বর্তমানে শিক্ষকতার কাজে ইংল্যান্ড-নিবাসী হলেও, তাঁর জন্ম বেড়ে ওঠা কলকাতার উপকণ্ঠেই। কলকাতার শিল্প-সংস্কৃতিই তাঁর গবেষণার অন্যতম ক্ষেত্র। তবে তাঁর কাছে ঐতিহ্য বলতে শুধুমাত্র ভিক্টোরিয়া, শহিদ মিনার কিংবা হাওড়া ব্রিজ নয়। সাধারণ মানুষের যাপনচিত্রও একটা শহরের ঐতিহ্যকে নিরূপণ করে কখনও কখনও। সে-কথাই স্পষ্ট ফুটে উঠছিল তাঁর কথায়। 

আগামী ৩০ ও ৩১ জুলাই কলকাতার রামকান্ত বোস স্ট্রিটের কমলা প্যালেসে আয়োজিত হতে চলেছে এক অদ্ভুত প্রদর্শনী শহরের সংবেদন। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন এবং ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই প্রদর্শনীতে (Exhibition) স্বর ও ঘ্রাণের (Sound And Smell) মাধ্যমে খোঁজ চলবে অন্য কলকাতার। খোঁজ চলবে ‘সিটি অফ জয়’-এর নানান ‘উপেক্ষিত’ ঐতিহ্যের। সেই প্রসঙ্গেই কথা হচ্ছিল এই প্রদর্শনীর অন্যতম উদ্যোক্তা ডঃ ঋষিকা মুখোপাধ্যায়ের (Rishika Mukhopadhyay) সঙ্গে। 

আরও পড়ুন
ক্যানসারাক্রান্ত ম্যাজিশিয়ান, চিকিৎসার খরচ জোগাতে বিশেষ ম্যাজিক প্রদর্শনী সতীর্থদের

শব্দ এবং গন্ধের সঙ্গে যেমন জড়িয়ে থাকে অসংখ্য স্মৃতি, তেমনই কখনও কখনও তা পরিচয়ও হয়ে ওঠে কোনো বিশেষ অঞ্চলের। কলকাতার বাইরে পা রাখলেই এক ঝটকায় টের পাওয়া যায় সেই পরিবর্তন। নিভে আসে ক্যাকাফোনি, ফেরিওয়ালা ডাক কিংবা কল-কারখানার নানান রাসায়নিক গন্ধ। এই স্বর, এই শব্দ যদি কলকাতার আলাদা করে পরিচয় হয়ে উঠতে পারে, তবে তাকে ঐতিহ্য বলা হবে নাই বা কেন? সহজ ব্যাখ্যা ঋষিকার। 

আরও পড়ুন
মানুষই সর্বোত্তম? প্রশ্ন তুলছে ‘ভেনিস বায়েনালে’ প্রদর্শনী

বছর কয়েক আগের কথা। তখন কলকাতার চিৎপুর রোডে গবেষণার কাজ চালাচ্ছেন ঋষিকা। সেইসময় থেকেই শুরু হয়েছিল তাঁর এইসব ‘উপেক্ষিত’ এবং ‘অদেখা’ ঐতিহ্য সংরক্ষণের লড়াই। মূলত বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্পের ইতিহাস ও বিবর্তন লিপিবদ্ধ করাই ছিল তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। তবে চিৎপুরের নানান ওয়ার্কশপে ঘোরার সময়, তাঁকে আকর্ষণ করে প্রতিটি শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আলাদা আলাদা স্বর, ভিন্ন ভিন্ন শিল্পীদের পৃথক বাচনভঙ্গি। শব্দ রেকর্ডিং-এর কাজ শুরু হয়েছিল সেখান থেকেই। 

আরও পড়ুন
শতাধিক বরেণ্য বাঙালির রেখাচিত্র, নববর্ষের প্রাক্কালে ব্যতিক্রমী প্রদর্শনী কলকাতায়


ঋষিকার কথায়, “প্রথম থেকেই ইচ্ছে ছিল, মানুষের রোজকার যাপনের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো বিষয়ে কাজ করব। তাছাড়া গবেষণার কাজে আমি বিস্তারিতভাবে হুতোমের বই পড়েছি। ওঁর লেখায় কলকাতার শব্দ ও গন্ধের এত বিস্তারিত বর্ণনা আছে, যেটা পড়ে মনে হত শব্দ ও গন্ধের মধ্যে বোধ হয় জীবনের একটা প্রতিফলন আছে। পরে দেখেছি এগুলো সেন্সরি হেরিটেজের আওতায় পড়ে। সেখান থেকেই এমন একটা প্রদর্শনীর চিন্তাভাবনা মাথায় আসে। যে ঐতিহ্য মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তার থেকে বাইরে গিয়ে আমরা শহরটাকে ধরতে চেয়েছি আমি।”

আগামী ৩০-৩১ জুলাই অনুষ্ঠিত হতে চলা এই প্রদর্শনীকে মূলত তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন ঋষিকা ও তাঁর সহ-উদ্যোক্তারা। প্রথম পর্যায়ে তুলে ধরা হবে সাহিত্যে শব্দ ও গন্ধের নানান বর্ণনাকে। হুতোম পেঁচা থেকে শুরু করে নবনীতা দেবসেন— এই গোটা সময়সীমাকেই বিভিন্ন আঙ্গিকে ধরতে চেষ্টা করেছেন উদ্যোক্তারা। দ্বিতীয় পর্যায়ে দেখা, থুড়ি শোনা যাবে পরিচিত, অপরিচিত ও স্বল্পপরিচিত নানান স্বর। যার মধ্যে নানান ফেরিওয়ালার ডাক থেকে শুরু করে রয়েছে যানবাহন, মিছিল, মিটিং, রাস্তার নির্মাণকাজ কিংবা শিল্পীদের শিল্পসৃষ্টির শব্দ। ‘সিটি অফ জয়’ কলকাতার শাব্দিক মানচিত্রও প্রদর্শিত হবে এই পর্যায়ে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বলা চলে এই প্রদর্শনীর তৃতীয় পর্যায়টিকে। 

হ্যাঁ, গন্ধ-বিচারেই কলকাতা চিনতে পারবেন দর্শকরা। চামড়ার কারখানার গন্ধ, নতুন ছাপা বই-এর গন্ধ, সোঁদা গঙ্গামাটির গন্ধ কিংবা বাজারের নানা ধরনের গন্ধ— সবকিছুই পরখ করে দেখতে পারবেন দর্শকরা। মাটির কুলুঙ্গিতে আলাদা আলাদা করে সংরক্ষিত হবে এইসব চিরাচরিত ঘ্রাণের নমুনা। “কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে এই গন্ধ ও শব্দগুলি সংগ্রহ করেছি আমরা। তাছাড়াও শব্দসংগ্রহের ক্ষেত্রে সর্বসাধারণের কাছেও আবেদন করেছিলাম। সেখানেও সাড়া মিলেছে ব্যাপকভাবে”, বলছিলেন ঋষিকা। 

প্রশ্ন থেকে যায়, শব্দ রেকর্ড করা গেলেও, কীভাবে গন্ধ সংরক্ষণ করছেন বাংলার গবেষকরা? বছর খানেক আগেই ‘গন্ধ-মিউজিয়াম’ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন ইউরোপের গবেষকরা। ‘ওড-ইউরোপা’-খ্যাত সেই প্রকল্পে কৃত্রিমভাবে চতুর্দশ কিংবা পঞ্চদশ শতকের নানা ঘ্রাণের নমুনাও তৈরি করেছিলেন তাঁরা। এক্ষেত্রেও কি তেমনটাই হচ্ছে? ঋষিকা জানালেন, “আমরা কোনো রসায়নবিদদের দিয়ে কৃত্রিমভাবে গন্ধ তৈরি করিনি। বরং, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পদার্থের নমুনা সংগ্রহ করেই সেই গন্ধটা দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি। এটা একটা পরীক্ষামূলক উদ্যোগ। পরবর্তীতে যদি কোনো কোলাবরেশন হয়, যদি কোনো স্মেল আর্টিস্টের সাহায্য পাই তবে কৃত্রিমভাবে গন্ধ সংরক্ষণের পথেও হাঁটতে পারি। তবে তার জন্য জায়গার প্রয়োজন পড়ে। সেটা একটা প্রতিবন্ধকতাও বটে।”

দু’দিনের এই আশ্চর্য প্রদর্শনী কলকাতা এক অন্য প্রেক্ষিতে হাজির করবে আমাদের সামনে, তা বলার অপেক্ষা থাকে না। তবে শুধু এই দু’দিনই নয়, জানা গেল প্রদর্শনীর জন্য সংগৃহীত শব্দগুলি নিয়ে তৈরি হচ্ছে একটি ডিজিটাল আর্কাইভ। সেই তথ্যভাণ্ডার খুলে দেওয়া হবে সকলের জন্যই। এমনকি বিভিন্ন শব্দ রেকর্ড করে সেই ওয়েবসাইটে আপলোডও করতে পারবেন ব্যবহারকারীরা। বাংলা তো বটেই, এমন বিচিত্র উদ্যোগ গোটা ভারতে হয়তো এই প্রথম…

Powered by Froala Editor

More From Author See More