৫০ বছর আগের সাবমেরিন দুর্ঘটনা, ৮৪ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে প্রাণ বেঁচেছিল যাত্রীদের

কোটি টাকা খরচ করে টাইটানিকের ধ্বংসস্তূপ দেখতে গিয়েছিলেন একদল বিলিয়নেয়ার। কিন্তু ঐতিহাসিক এই ট্র্যাজেডি প্রত্যক্ষ করতে গিয়ে যে নতুন করে ট্র্যাজেডির শিকার হবেন তাঁরা, তা কেই-বা জানত! গত পরশু আটলান্টিকের সমুদ্রের গভীরে তলিয়ে যায় পর্যটকদের জন্য তৈরি ‘ওশানগেট এক্সপিডিশন’-এর ছোট্ট সাবমেরিন ‘পোলার প্রিন্স’। তারপর পেরিয়ে গেছে ৪৮ ঘণ্টা। তবে এখনও খোঁজ মেলেনি টাইটানিক সাবমার্সিবলের। আদৌ কি উদ্ধার করা সম্ভব এই সাবমেরিনের মধ্যে আটকে থাকা মানুষদের? 

ইতিহাস বলছে, সম্ভব। আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে এমনই এক তাজ্জব ঘটনা (Submarine Accident) ঘটেছিল আটলান্টিকের (Atlantic) বুকেই। সাবমেরিনে আটকে পড়া দুই ব্যক্তিকে ৮৪ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস যুদ্ধের পর শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করেছিল রয়্যাল নেভি। তখন আর মাত্র ১২ মিনিটের অক্সিজেন অবশিষ্ট ছিল এই ডুবজাহাজে। কীভাবে হয়েছিল এই দুর্ঘটনা? কীভাবেই-বা এই সাবমেরিনের মধ্যে আটকে থাকা মানুষদের উদ্ধার করেছিল সেনাবাহিনী? 

সত্তরের দশকের শুরুর দিক। আটলান্টিকের সমুদ্রগর্ভে ‘ট্রান্স-আটলান্টিক’ টেলিফোন কেবল-লাইন স্থাপনের কাজ চলছে পুরোদমে। মূলত সাবমেরিনে চেপেই সমুদ্রগর্ভে পাড়ি দিতেন কর্মীরা। মূলত তাঁরা সকলেই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক বা সৈনিক। ফলে সাবমেরিন চালনার এই কঠিন দায়িত্ব যে দক্ষ হাতেই পালন করতেন তাঁরা, তা নিয়ে প্রশ্ন নেই কোনো। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫০০ মিটার অর্থাৎ ১৬০০ ফুট ডুব দেওয়ার পর, বিভিন্ন যন্ত্রাংশের মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশে বিছিয়ে দেওয়া হত টেলিফোনের লাইন। 

দিনটা ছিল ১৯৭৩-এর ২৯ আগস্ট। আয়ারল্যান্ড উপকূল থেকে ১৫০ মাইল দূরে ‘পিসেস-৩’ সাবমেরিনে চেপে কেবল-লাইনের স্থাপনের জন্য আটলান্টিকে ডুব দিয়েছিলেন রয়্যাল নেভির প্রাক্তন সাবমেরিন চালক রজার ম্যালিসন এবং ইঞ্জিনিয়ার রজার চ্যাপম্যান। শিকল এবং অন্যান্য তারের সঙ্গে ছোট্ট এই সাবমেরিন সংযুক্ত ছিল আটলান্টিক মহাসাগরে ভাসমান একটি বড়ো জাহাজের সঙ্গে। দীর্ঘ ৮ ঘণ্টা কাজের পর যখন ওপরে ওঠার পালা, তখনই ঘটে যায় দুর্ঘটনা। 

কোনোভাবে শিকলে টান লেগে খুলে যায় সাবমেরিনের একটি হ্যাচ। সঙ্গে সঙ্গে জল ঢুকতে শুরু করে সাবমেরিনের পিছনের অংশে। মূলত এই অংশটি ছিল কেবল পাতার যন্ত্রাংশ। অন্যদিকে সাবমেরিনের সামনের অংশে ছিলেন ম্যালিনসন এবং চ্যাপম্যান। জল ঢুকে ভারী হয়ে যাওয়ার ফলে শিকলের সংযোগ ছিন্ন হয়ে যায় মূল জাহাজের সঙ্গে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সমুদ্রগর্ভে আছড়ে পড়ে ‘পিসেস-৩’ (Pisces III)। সৌভাগ্যবশত আটলান্টিকের নিচে পাথরে ধাক্কা না খেয়ে পলির মধ্যে গেঁথে যায় এই সাবমেরিন। 

ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ৯.৩০। এই দুর্ঘটনার ১৫ মিনিটের মধ্যেই উদ্ধারকার্যের জন্য যুক্তরাজ্য থেকে পাড়ি দেয় রয়্যাল নেভির বিশেষ দল। এয়ারলিফটের মাধ্যমে আয়ারল্যান্ডে পাঠানো হয় ২টি বাড়তি সাবমেরিন— ‘পিসেস ২’ এবং ‘পিসেস ৫’। দুটি সাবমেরিনেই বিশেষ যন্ত্রাংশ স্থাপন করা হয়েছিল উদ্ধারকার্যের জন্য। পাশাপাশি উদ্ধারকার্যের জন্য পাঠানো হয় রয়্যাল নেভির হেলিক্যারিয়ার এইচএমএস হেক্টরকে।

অবশ্য উদ্ধারকাজ শুরু হতে হতেই লেগে যায় প্রায় একদিন। ডুবে যাওয়া সাবমেরিনটিকে তুলে আনা সম্ভব, এই নিশ্চয়তা রয়্যাল নেভি দিলেও, চ্যাপম্যান এবং ম্যালিসনের প্রাণসংশয় ছিলই। কারণ, অক্সিজেন এবং খাদ্য-পানীয়ের অভাব। যখন এই সাবমেরিন ডুবে যায়, তখন জাহাজে সঞ্চিত ছিল ৭২ ঘণ্টার অক্সিজেন। মাত্র ৩-৪টি স্যান্ডউইচ এবং একটি লেমোনেড। পাশাপাশি জাহাজের যে-টুকু জ্বালানি ছিল, তা ২ দিনের শক্তি উৎপাদন করতেও অক্ষম। ফলে অক্সিজেন ব্যবহারের হার কমিয়ে দেন দুই কর্মীই। ৭২ ঘণ্টার অক্সিজেনকে ব্যবহার করেই ৮৪ ঘণ্টা অতিবাহিত করেছিলেন চ্যাপম্যান ও ম্যালিসন। না-খেয়েই কাটিয়েছিলেন দীর্ঘক্ষণ। 

হ্যাঁ, ৮৪ ঘণ্টা। আসলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই সাবমেরিনের কাছে পৌঁছে গেলেও, তার পিছনের ট্যাঙ্ক থেকে জল নিষ্কাশন, শিকল সংযোজনে লেগে যায় বেশ খানিকটা সময়। তাছাড়া পলির মধ্যে থেকে সাবমেরিনটিকে টেনে বার করতেও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল উদ্ধারকারীদের। এদিকে ৫০০ মিটার গভীরে যে ডুবুরিদের সাহায্যে আটকে পড়া মানুষদের বের করে আনারও উপায় নেই কোনো। এত গভীরে জলের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা নেই মানুষের। 

শেষ পর্যন্ত রয়্যাল নেভির যুদ্ধজাহাজ শিকলের মাধ্যমে টেনে তোলে আটকে পড়া ‘পিসেস-৩’-কে। সমুদ্রপৃষ্ঠে পৌঁছানোর পর মাত্র ১২ মিনিটের অক্সিজেন সংরক্ষিত ছিল সেখানে। পাশাপাশি কম অক্সিজেন নিয়ে দীর্ঘক্ষণ বন্দি থাকার জন্য সাময়িকভাবে অসুস্থও হয়ে পরেছিলেন দুই কর্মী।

সে-যুগে এই রুদ্ধশ্বাস উদ্ধারকার্য সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা বিশ্বে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রে লেখা হয়েছিল চ্যাপম্যান ও ম্যালিসনের প্রত্যাবর্তন নিয়ে। শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন রানি এলিজাবেথও। তবে এখানেই থেমে থাকেননি চ্যাপম্যান। মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরার পরেও আবার ফিরে গিয়েছিলেন সেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। এমনকি পরবর্তীতে তিনি নিজেই তৈরি করেন সাবমেরিন উদ্ধারের একটি বিশেষ দল। ‘রুমিক’-খ্যাত এই দল একাধিক জাহাজ দুর্ঘটনার শিকার হওয়া মানুষদের উদ্ধারের কাজ করেছে। ২০০৩ সালে উদ্ধার করেছিল ডুবে যাওয়া রাশিয়ান সাবমেরিনের ৭ জন কর্মীকেও। 

‘পিসেস-৩’-এর এই রুদ্ধশ্বাস উদ্ধারকার্যই এখন যেন নতুন করে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে ‘টাইটান-সাব’-এর উদ্ধারকারী দলকে। যদিও এবারের এই দুর্ঘটনা আরও চ্যালেঞ্জিং। ১৯৭৩-এ মূল জাহাজের সঙ্গে টেলি যোগাযোগ ছিন্ন না-হওয়ায় সাবমেরিনের অবস্থান বুঝতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি উদ্ধারকর্মীদের। পাশাপাশি সেটির গভীরতাও ছিল তুলনামূলকভাবে কম। টাইটান-সাবমেরিনটি একই-ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হলে তা গেঁথে যাওয়ার কথা সমুদ্রপৃষ্ঠের ১২৫০০ ফুট নিচে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবও রয়েছে সেখানে। সবমিলিয়ে উদ্ধারের সম্ভাবনা ১ শতাংশেরও কম বলেই অভিমত বিশেষজ্ঞদের। 

Powered by Froala Editor