বিশ্বকাপের মাঠে একে অপরের বিপক্ষে খেলেছেন দুই ভাই! এক আশ্চর্য কাহিনি

‘ব্রাদার্স লুক আউট ফর ইচ আদার…’

যাঁরা সুপারহিরো মুভি দেখতে অভ্যস্ত, তাঁরা অনেকেই পরিচিত ‘এক্সমেন অরিজিন্স’ ছবির এই কিংবদন্তি ডায়লগের সঙ্গে। সঙ্গীত, শিল্প, খেলা, বিজ্ঞান কিংবা যুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন সহোদর, সহোদরারা— এমন উদাহরণ রয়েছে অজস্র। কিন্তু দুই ভাই-এর মধ্যেই যদি উঠে যায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রাচীর? 

২৩ জুন, ২০১০। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের সকার সিটি স্টেডিয়াম। গ্রুপ পর্বের ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল জার্মানি এবং ঘানা। সেদিন তৈরি হয়েছিল বিশ্বকাপের (FIFA World Cup) ইতিহাসের এক অনন্য নজির। বিশ্বকাপের মঞ্চে প্রথমবারের জন্য দুই ভাই প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন দুই ভিন্ন দেশের। তাও একই ম্যাচে। 

প্রথমজনের নাম জেরোম বোয়াতেং (Jerome Boateng)। কিংবদন্তি জার্মান (Germany) ডিফেন্ডার এবং বায়ার্ন-তারকাকে চেনেন না, এমন ফুটবলপ্রেমীর সংখ্যা বিরল। তবে দ্বিতীয় নামটি অনেকেরই অজানা। কেভিন-প্রিন্স বোয়াতেং (Kevin Prince Boateng)। ঘানার (Ghana) মাঝমাঠ সামলানোর দায়িত্ব সেদিন ছিল তাঁর কাঁধেই। তবে মাঠে নামার আগেই সমালোচনায় বিদ্ধ হন কেভিন-প্রিন্স। এমনকি বিশ্বকাপ শুরুর কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই তাঁর সঙ্গে কথাও বন্ধ ছিল জেরোমের! কিন্তু কী নিয়ে এই দ্বন্দ্ব? কীভাবে-ই বা দুটি ভিন্ন আন্তর্জাতিক শিবিরের অংশ হয়ে উঠলেন বোয়াতেং-ভাতৃদ্বয়? 

এই গল্পের শুরু আজ থেকে ৪১ বছর আগে। ১৯৮১ সাল। কর্মসূত্রে ঘানা থেকে বার্লিনে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন বোয়াতেং ভাতৃদ্বয়ের বাবা প্রিন্স। ১৯৮৭ সালে জন্ম নেয় তাঁর যমজ সন্তান জর্জ এবং কেভিন-প্রিস। তবে ততদিনে দ্বিতীয়বার জার্মানির মাটিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন তিনি। এই দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী-এর সন্তানই জেরোম। বয়সে অন্য দুই ভাই-এর থেকে ১৮ মাসের ছোটোও তিনি। 

ছোটো থেকেই ফুটবলই ছিল তিন ভাই-এর নেশা। ফুটবল অ্যাকাডেমিতে যাওয়া থেকে শুরু করে পড়াশোনা— একসঙ্গেই বেড়ে ওঠা তিনজনের। এমনকি বোয়াতেং-ত্রয়ীর মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ফুটবলার ছিল জর্জ— এমনটাই জানিয়েছিলেন বার্লিনের ফুটবল তারকারাও। তবে জর্জই সর্বপ্রথম লাইনচ্যুত হন সাফল্যের পথ থেকে। নেশা, ড্রাগস, অপরাধজগৎ— ধীরে ধীরে অন্ধকারে তলিয়ে যান তিনি। 

পরবর্তী প্রিন্সের প্রথম পক্ষের স্ত্রী-এর সঙ্গে জর্জ ও কেভিন স্থানান্তরিত হলেও, জেরোম থেকে যান বাবার সঙ্গেই। খেলতেন বার্লিন অ্যাকাডেমিতে। ততদিনে দেশের যুব-দলে ফরোয়ার্ড হিসাবে জায়গা পাকা করে ফেলেছেন কেভিন। এমনকি ২০০৬ সালে পেয়েছিলেন সে-দেশের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ সম্মাননা ফ্রিটজ ওয়াল্টার মেডেল। এক বছরের মধ্যে টটেনহ্যামে খেলার সুযোগও চলে আসে তাঁর কাছে। তারপর সেখান থেকে পোর্টমাউথ। অন্যদিকে দাদার সাফল্যের দু’বছরের মধ্যেই জার্মানিতে একই পদকজয় করেন জেরোম। 

সমস্যা শুরু হয় এর পর পরই। ২০০৯ সাল সেটা। অনূর্ধ্ব-২১ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ স্কোয়াডে সেবার জায়গা পেয়েছিলেন কেভিন। অথচ, প্রতিযোগিতা শুরুর দু’দিন আগে গোটা রাত নাইটক্লাবে খেলার জন্য তাঁকে স্কোয়াড থেকে বাদ দেন ডিএফবি-র পরিচালক ম্যাথিয়াস সামার। তাঁর অভিযোগ উঠেছিল নিয়ম-শৃঙ্খলা অভাব এবং অহংকার নিয়ে। কোচ তো বটেই, জার্মান ফুটবল বোর্ডও বেশ কড়া ভাষাতেই এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল কেভিনকে। এরপরই দল বদলের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। নাগরিকত্ব বদল করে যোগ দেন সাবেক ‘মাতৃভূমি’-র শিবিরে। ঘানায়। অন্যদিকে জার্মানির জাতীয় শিবিরে নিজের জায়গা পাকা করে ফেলেন জেরোম। 

২০১০ সালে বিশ্বকাপ শুরুর কয়েক মাস আগের কথা। এফএ কাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল চেলসি এবং পোর্টমাউথ। সেদিন চেলসির হয়ে খেলতে নেমেছিলেন জার্মানির ক্যাপ্টেন মাইকেল বালাক। কেভিনের কড়া ট্যাকেলে ভয়ঙ্করভাবে আহত হন তিনি। আর এরপরই প্রায় যুদ্ধ শুরু হয় বোয়াতেং ভাতৃদ্বয়ের মধ্যে। সে-সময় জার্মান মিডিয়া সমালোচনার ঝড় তুলেছিল কেভিনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ তুলেছিল, ইচ্ছা করেই বিশ্বকাপের আগে তিনি জখম করেছেন জার্মান ক্যাপ্টেনকে। এমনকি চুপ থাকেননি জেরোমও। সমালোচনা ছাড়াও, কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন দাদার সঙ্গে। 

২০১০ এবং ২০১৪— পর পর দুটি বিশ্বকাপেই জার্মানির সঙ্গে গ্রুপ পর্বে সাক্ষাৎ হয় ঘানার। দুটি ম্যাচেই মুখোমুখি হয়েছিলেন বোয়াতেং ভাতৃদ্বয়। প্রথম ম্যাচটিতে মেসুট ওজিলের গোলে ১-০ ব্যবধানে জিতেছিল জার্মানি। দ্বিতীয়টি শেষ হয়েছিল ২-২ গোলে অমীমাংসিতভাবেই। সেবার গ্রুপ পর্বে ঘানা জার্মানিকে রুখে দিলেও, বিশ্বকাপে শেষ হাসি হাসে জোয়াকিম লো-এর বাহিনীই। এমনকি সে-দেশে জেরোম বোয়াতেং হয়ে ওঠেন জাতীয় নায়ক। তবে দুই ভাই-এর প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা আর মনে রাখেননি কেউ-ই। 

যেখান থেকে শুরু হয়েছিল এই গল্প, সেই ডায়লগেই আবার ফিরে যাওয়া যাক শেষে এসে। ‘ব্রাদার্স লুক আউট ফর ইচ আদার’— এ-কথা অস্বীকার করা যায় কীভাবে? জেরোমের মতো ঝলমলে কেরিয়ার কোনোদিনই গড়ে তুলতে পারেননি কেভিন-প্রিন্স। বার বার শিকার হতে হয়েছে সমালোচনা, অভিযোগের। তবে সাধ্যমতো পাশে দাঁড়িয়েছেন জেরোম। কখনও আবার একইসঙ্গে প্রতিবাদ করেছেন বর্ণবাদ নিয়ে। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও কর্মজগৎ প্রত্যেকের জীবনের দুটি পৃথক অধ্যায়— তা-ই যেন মনে করিয়ে দেয় এই দুই ভাই-এর গল্প। 

তবে শুধু বোয়াতেং ভাতৃদ্বয়ই নয়, চলতি বছরের বিশ্বকাপেও দুটি পৃথক দেশের হয়ে খেলার নজির গড়েছেন আরও দুই সহোদর ফুটবলার। নিকো এবং ইনাকি উইলিয়ামস। প্রথম জন খেলছেন স্প্যানিশ আর্মাডার হয়ে আর ইনাকি ঘানার জাতীয় শিবিরের সদস্য। এ-বিশ্বকাপে এই দুই দলের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে এমনটা হলে রচিত হবে নতুন এক ফুটবল-সাহিত্য, তাতে সন্দেহ নেই কোনো… 

Powered by Froala Editor