খেলতে আসবেন ‘ঈশ্বর’, যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হল দেশে!

“হাউ ডু ইউ স্পেল পেলে? ইট’স ইজি। জি-ও-ডি।”

২১ জুন, ১৯৭০। সেদিন ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনালের আসর বসেচে মেক্সিকোর অ্যাজটেকা স্টেডিয়ামে। মুখোমুখি ইতালি ও ব্রাজিল। আর সেই ম্যাচে ১৯ মিনিটের মাথাতেই গোল করে ব্রাজিলকে ম্যাচের চালকাসনে বসিয়েছিলেন পেলে (Pele)। আর তার ঠিক পরেই ব্রিটিশ ধারাভাষ্যকার ও ফুটবলার ম্যালকম অ্যালিসন এবং প্যাট ক্রেরান্ডের কণ্ঠে শোনা গিয়েছিল এই আশ্চর্য বাণী। 

হ্যাঁ, ঈশ্বরই বটে। ফুটবলের ইতিহাসে এক বিস্ময়ের নাম পেলে। একক দক্ষতায় ম্যাচের ভাগ্য বদলে দেওয়া তো বটেই, দেশকে তিন-তিনটি বিশ্বকাপও এনে দিয়েছেন তিনি। পাঁচ দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরও পেলের এই নজির কেউ স্পর্শ করতে পারেনি আজও। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনা করাই চলে তাঁকে। তবে পেলের কৃতিত্ব ফুটবল মাঠের মধ্যে আবদ্ধ নয় মোটেই। ষাটের দশকে পেলে-মাদকতা পৌঁছে গিয়েছিল মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এমনকি তাঁর জন্য থেমেছিল গৃহযুদ্ধও (Civil War)!

হ্যাঁ, অবাক লাগলেও সত্যি। সেটা ১৯৬৯ সাল। নিজের ঝুলিতে ততদিনে দু-দুটি বিশ্বকাপ পুরে ফেলেছেন তিনি। ১৯৬৬-র বিশ্বকাপ হাত ছাড়া হলেও, পেলে তখন হয়ে উঠেছেন ফুটবল কিংবদন্তি। ১৯৭০-এর বিশ্বকাপেরও অন্যতম দাবিদার তাঁরাই। পেলের এই জনপ্রিয়তাকে বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগাতেই, বিশ্ব-সফরের সিদ্ধান্ত নেয় তাঁর ক্লাব স্যান্টোস। ঠিক হয় বিভিন্ন দেশে গিয়ে সেখানকার জাতীয় দল কিংবা ক্লাবের সঙ্গে খেলবে স্যান্টোস। এবং অবশ্যই স্যান্টোসের হয়ে প্রতিটা ম্যাচে মাঠে নামবেন পেলে।

১৯৬৯-র জানুয়ারি মাস। পেলের আফ্রিকা-সফর শুরু হয়েছিল কঙ্গো থেকে। তারপর মোজাম্বিক, ঘানা, আলজেরিয়া। শেষে নাইজেরিয়া সফর। তবে নাইজেরিয়ার ম্যাচ নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল প্রথম থেকেই। আফ্রিকার এই রাষ্ট্রটি তখন অগ্নিকুণ্ড। চলছে গৃহযুদ্ধ। প্রতিদিনই লাশ পড়ছে কোনো না কোনো মানুষের। চলছে নিপীড়ন, ধর-পাকড়। 

একদিকে যেমন দুর্ভিক্ষ ছিল এই সহিংসতার অন্যতম কারণ, তেমনই জাতিগত ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ভিন্ন হওয়ায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যেই শুরু হয়েছিল সশস্ত্র সংঘাত। স্থানীয় জনগোষ্ঠী ‘ইগবো’-র মানুষদের অভিযোগ ছিল তাঁদের উন্নয়ন এবং অন্যান্য চাহিদা মেটানোর জন্য কোনো উদ্যোগই নেয় না নাইজেরিয়ার ফেডারাল সরকার। বরং, জাতিগত ভিন্নতার কারণেই চিরকাল বৈষম্যের শিকার হতে হয় তাঁদের। উল্লেখ্য, তৎকালীন সময়ে ফেডারাল সরকারের অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন নাইজেরিয়ার আরেক জনগোষ্ঠী ‘হাউসা’-এর সদস্য। তাই পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের ডাক দিয়েছিলেন ইগবোরা। নাইজেরিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলটির নামকরণ করেছিলেন ‘বায়াফ্রা’। 

তবে মজার বিষয় হল, এই যুদ্ধ-পরিস্থিতিতেও স্যান্টোসের আফ্রিকা-সফরের কথা জানতে পেরে, নাইজেরিয়ায় দেশে খেলতে আসার জন্য স্যান্টোস কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলেন সে-দেশের প্রশাসন। অবশ্য শুধু প্রশাসন বললে ভুল হয়, কারণ নাইজেরিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী ইগবোরাও মনেপ্রাণে চাইতেন তাঁদের মাতৃভূমিতে পা পড়ুক ‘ঈশর’-এর। হ্যাঁ, রাজি হয়েছিল স্যান্টোস। তবে ছোট্ট শর্ত ছিল একটা। পেলে এবং স্যান্টোসের সমস্ত খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে তবেই সে-দেশে অবতরণ করবে দল। 

স্যামুয়েল ওগবেমুদিয়া। সে-সময় নাইজেরিয়ার গভর্নর ছিলেন তিনি। নাইজেরিয়ায় পেলের বিমান অবতরণের আগেই দেশ-জুড়ে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি জারি করেন স্যামুয়েল। যুদ্ধবিরতির বিজ্ঞপ্তি। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যদি আন্দোলন চালিয়ে যেতে চান তাতে অসুবিধা নেই কোনো। তবে সাময়িকভাবে দিন দুয়েকের জন্য যুদ্ধবিরতিতে সায় দিতে হবে তাঁদের। সরকারের বাহিনীই হোক কিংবা আন্দোলনকারী— ৪৮ ঘণ্টা গুলি চালাবে না কোনোপক্ষই। এমনকি হবে না ধর-পাকড়ও। আর তেমনটা যদি হয়, তবে সে-দেশে দেখা যাবে ফুটবলের ম্যাজিক। হ্যাঁ, গভর্নর-এর এই প্রস্তাবে শেষ অবধি সই দিয়েছিল ইগবো গেরিলা নেতারা। যুযুধান দুই পক্ষই এক হয়ে গিয়েছিল পেলে-ম্যাজিক দেখার জন্য। টানা তিন দিন সে-দেশে জারি ছিল যুদ্ধবিরতি। এমনকি স্টেডিয়ামে হাজির দর্শক ও খেলোয়াড়দের সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিল দুই পক্ষের সামরিক বাহিনীই। ২৬ জানুয়ারির সেই ম্যাচে বন্দুক হাতেই লাগোস সিটি স্টেডিয়ামের বাইরে পাহারা দেন তাঁরা। 

উল্লেখ্য, ‘গ্রিন ইগল’-খ্যাত নাইজেরিয়ার জাতীয় দলের বিরুদ্ধে খেলতে নেমে পেলে দুটি গোল করলেও, সেই ম্যাচ জিততে পারেনি স্যান্টোস। যুদ্ধবিধ্বস্ত নাইজেরিয়ায় সেবার ২-২ গোলে ড্র করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। অবশ্য ফুটবল ম্যাচ না জিততে পারলেও, হাজার হাজার নাইজেরিয়ানের হৃদয় জয় করেছিলেন পেলে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তবে নাইজেরিয়ার সঙ্গে এখানেই সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়নি পেলের। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে ফের নাইজেরিয়ায় পা রেখেছিলেন পেলে। ততদিনে ইতি পড়েছে গৃহযুদ্ধে। সেবার স্থানীয় দুটি দলের প্রীতিম্যাচে ৪৫ মিনিট খেলেছিলেন পেলে। এমনকি তাঁকে বিশেষ সম্মাননাও দিয়েছিল নাইজেরিয়া প্রশাসন। 

অবশ্য পেলের যুদ্ধ-থামানোর এই আশ্চর্য গল্প আদৌ সত্যি নাকি মিথ— তা নিয়ে তর্ক ঘনিয়েছিল আশির দশকে। আসলে ১৯৬৯ সালে ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবো স্পোর্তে’-তে এই খবর প্রকাশ পেলেও, তাকে সেভাবে পাত্তা দেয়নি পশ্চিমী দুনিয়ার সংবাদমাধ্যমরা। অন্যদিকে ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত পেলের আত্মজীবনীতেও জায়গা পায়নি এই গল্প। অবশ্য পরবর্তী এক সাক্ষাৎকারে এবং ২০২০ সালে নিজের সোশ্যাল মিডিয়াতেও পেলে জানান, তাঁর জীবনের সবচেয়ে গর্বের মুহূর্ত ছিল এটিই…

Powered by Froala Editor