গয়না চুরির অভিযোগ অধিনায়কের বিরুদ্ধে! বিশ্বকাপ খেলার আগেই আটক ববি মুর

‘ডিফেন্স ইজ দ্য বেস্ট অফেন্স’। 

এতটুকু ভুল নয় এই প্রবাদবাক্য। শুধু যুদ্ধের ময়দানই নয়, ফুটবলের ক্ষেত্রেও প্রযোগ্য এই কথা। রক্ষণভাগে বাঁধন গড়ে তুলতে না পারলে, হাজার আক্রমণাত্মক খেললেও বিপর্যয় ঘনিয়ে আসতে পারে যে-কোনো শিবিরের। ফুটবলের দুনিয়ায় স্ট্রাইকার বা উইঙ্গাররা সবচেয়ে বেশি লাইম-লাইটে এলেও, না-বলা থেকে যায় ডিফেন্ডারদের কারিগরি। ১৯৯৪ বিশ্বকাপ জয়ের কথাই ধরে নেওয়া যেতে পারে। সেবার বেবেতো, রোমারিও, রোনাল্ডোদের নামের আড়ালেই রয়ে গিয়েছিল গিলবার্তো সিলভার নাম। ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ এনে দেওয়ার পিছনে ‘ইনভিসিবল ম্যান’-এর ভূমিকাও কি কম ছিল কোনো অংশে?

তবে ডিফেন্ডাররা ঠিক কতটা জরুরি, তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায় ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপে চোখ রাখলেই। সেবার শেষ হাসি হেসেছিল পেলের ব্রাজিল। তবে ধারে-ভারে কোনো অংশেই পিছিয়ে ছিল না ইংল্যান্ড। ডিফেন্ডিং কাপ চ্যাম্পিয়নও ছিল তারাই। অথচ, মূল দল থেকে কেবলমাত্র একজন ডিফেন্ডারের সাময়িক ছিটকে যাওয়াই রীতিমতো কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের কাছে। 

কথা হচ্ছে, ববি মুরকে (Bobby Moore) নিয়ে। ১৯৬৬-র বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম নায়ক তিনি। ১৯৭০-এ ইংল্যান্ডের (England) অধিনায়কের আর্মব্যান্ডও পরেছিলেন ববি মুর। তবে অপ্রত্যাশিত একটি ঘটনাই তাঁকে সাময়িকভাবে লাইনচ্যুত করে দিয়েছিল ফুটবল বিশ্বকাপ থেকে। ঠেলে দিয়েছিল প্রবল মানসিক চাপের মধ্যে। 

বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার ঠিক আগের কথা। কলোম্বিয়ার বোগোতা শহরে পৌঁছে গেছে ইংল্যান্ডের শিবির। সেখানেই পুরোদমে চলছে তাদের অনুশীলন। কিন্তু সারাদিন কি আর ফুটবল মাঠে বা হোটেল রুমে বসে কাটানো যায়? অবসর কাটাতে কয়েকজন সতীর্থের সঙ্গে বোগোতার পথে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন ববি মুর। ঘুরতে ঘুরতে তিনি পৌঁছে যান একটি গহনার দোকানে। অবশ্য ‘ফুয়েগো ভার্দে জুয়েলার্স’-খ্যাত সে-দোকানে নিজে থেকে ঢোকার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না মুরের। তবে দোকানের বাইরে থেকে কাচের জানলা মধ্যে দিয়ে একটি হিরের আংটি দেখে আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁরই সতীর্থ ববি চার্লটন। স্ত্রী-এর জন্য সেই আংটি কেনার জন্য দোকানে ঢোকেন তিনি। তাঁকে অনুসরণ করেন মুর। নিজে কিছু না কিনলেও, সতীর্থদের হয়ে দর কষাকষি করছিলেন তিনি। আর তার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বাঁধে গোলযোগ।  

বেশ কয়েকজন কর্মচারী এসে উত্তপ্তভাবে কথাবার্তা শুরু করেন দোকানের মধ্যে। স্প্যানিশ ভাষায় তাঁরা কী বলছে, ব্যাপারটা বোধগম্য হয়নি কারোরই। তবে ইংল্যান্ড দলের সকলেই বুঝতে পেরেছিলেন, দোকান থেকে হারিয়ে গেছে কোনো দামি জিনিস। খানিকবাদে পরিষ্কার হয় ব্যাপারটা। যে জিনিসটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তা হল ১২টি হিরে ও এমারাল্ড বসানো ১৮ ক্যারেটের একটি ব্রেসলেট। এবং দোকানের কর্মীদের অভিযোগ সেটা চুরি করেছেন খোদ ববি মুর!

প্রাথমিকভাবে ইংল্যান্ড দলের সকলেই ভেবেছিল এই ঘটনা একটি নিতান্ত ভুল বোঝাবুঝি। তবে কথা বলে বিষয়টার সমাধান করা তো দূরের কথা, ছোট্ট এই ঘটনাই পরিণত হয় রীতিমতো কেলেঙ্কারিতে। জল গড়ায় পুলিশি বিভাগ পর্যন্ত। কিছুক্ষণের মধ্যেই, মুর ও চার্লটনকে নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশি দপ্তরে। প্রথমে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পর ছাড়া পান মুর। তবে জটিলতা কাটেনি। কলোম্বিয়ার বিরুদ্ধে দুদিন পরে ইংল্যান্ড দলকে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে হয়েছিল মিলিটারি ক্যাডেট স্কুলের স্টেডিয়ামে। সেই ম্যাচের পর ফের ডাক আসে মুরের। ফের জেরার সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে। সাময়িকভাবে বিশ্বকাপের আগে তাঁকে আটকও করে কলোম্বিয়ার পুলিশ। 

বলাই বাহুল্য, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চুরির এই দায় অস্বীকার করেছিলেন ববি। একই অবস্থান নিয়েছিলেন তাঁর সতীর্থ ও দলের কোচও। অন্যদিকে অভিযোগকারী তরুণী ও দোকানের মালিকের বয়ান পাল্টেছে বার বার। প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসাবে হঠাৎ-ই উদয় হয়েছিল আলভারো সুয়ারেজ নামের এক কলোম্বিয়ান হকার। তাছাড়া তল্লাশি চালিয়েও কোনো যুক্তিযুক্ত প্রমাণ খুঁজে পায়নি কলোম্বিয়ার পুলিশ ও গোয়েন্দারা। কাজেই এই ঘটনা যে সবটাই সাজানো, তা অনুমান করা যায় সহজেই। 

তা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম চুপ করে বসে থাকেনি। মুর ছাড়া পাওয়ার পরও ক্রমাগত তাঁকে নিয়ে চর্চা চলেছে খবরের পাতায়। একটা সময় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল বিশ্বকাপে আদৌ ইংল্যান্ড শিবিরের হয়ে তিনি খেলতে পারবেন কিনা। এমনকি কলোম্বিয়া থেকে গোটা ইংল্যান্ড দল বিমানে চেপে যখন পানামায় পাড়ি দিয়েছিল মেক্সিকো যাওয়ার আগে, তখনও মুর বন্দি ছিলেন পুলিশের দপ্তরে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপের ঠিক আগে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় তাঁর থেকে। বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র কয়েকদিন আগে সতীর্থদের সঙ্গে দলে যোগ দেন তিনি। তবে সমালোচনা থামেনি। কলোম্বিয়া তো বটেই, মেক্সিকোতে মূল পর্বে খেলতে যাওয়ার সময়ও সাংবাদিক সম্মেলনে এই বিষয়টি নিয়ে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয়েছিল ববি মুরকে। 

এই চরম মানসিক চাপ সামাল দিয়েও, খুব একটা খারাপ খেলেননি ববি। বিশেষ করে গ্রুপ পর্বে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে খেলতে নেমে জার্জিনহোর নিশ্চিত গোল আটকে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছিলেন শান্ত মাথায়। বক্সের মধ্যে নিখুঁত ট্যাকেলে বার বার বাঁচিয়েছিলেন তেকাঠি। তবে মুরের ব্রেসলেট কেলেঙ্কারির কারণে মনোবল ভেঙে গিয়েছিল গোটা ইংল্যান্ড দলেরই। হারিয়েছিল চেনা ছন্দটাও। জার্মানির কাছে ৩-২ গোলে হারের কারণ হিসাবে আজও অনেকেই তুলে ধরেন কলোম্বিয়ার সেই অন্ধকার অধ্যায়কেই। আর সেই অভিশপ্ত ব্রেসলেট? ৫২ বছর পেরিয়ে সেই রহস্যের সমাধান মেলেনি আজও…

তথ্যসূত্রঃ
১. Bobby Moore and the mystery of the missing Bogotá bracelet, Carl Worswick, The Guardian
২. Fifty years on, the mystery of the Bogotá Bracelet remains unsolved, Alan Hubbard, Inside The Games

Powered by Froala Editor