‘মেজাজটাই আসল রাজা’ বুঝিয়েই ইনিংস শেষ করলেন ‘ইউনিভার্সাল বস’

একটা পাহাড়ের মতো মানুষ জীবনের শেষ ইনিংস শেষ করে প্যাভিলিয়নে ফিরছেন। ব্যাটের ওপরে হেলমেট। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে এতদিনের সম্পর্ক শেষ। বিষণ্ণতা, আবেগ এই ফেরার ফুটওয়ার্কে থাবা বসাবে স্বাভাবিক। কিন্তু ক্রিস গেইল যে অন্য ধাতুতে গড়া। আধুনিক ক্রিকেটের এক বিস্ময় চরিত্র তিনি। বিশ্বকাপে শর্ট থার্ডম্যানে বিরাট কোহলির শট আটকে হাত তুলে দর্শকদের অভিবাদন নেবেন, নিজের যৌনজীবন নিয়ে খোলামেলা মজা করবেন, ঘোষণা করবেন তিনিই আধুনিক ক্রিকেটের ‘ইউনিভার্সাল বস’। সেই মানুষটি বিদায়বেলাতেই বা বিষণ্ণতা ছড়াবেন কীভাবে। তাই ক্যারিবিয়ান সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপেও ক্রিকেট রোমান্টিকতার বীজ বুনতে বুনতেই তিনি প্যাভিলিয়নে ফেরেন। মুখে হাসি। বিরাট কোহলির সঙ্গে মজায় মেতেছেন সামান্য আগেই। তাঁর মেজাজের সঙ্গে মানানসইভাবেই তাঁকে বিদায় জানিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটারেরা। সেখানে ধ্রুপদী গাম্ভীর্য নেই, কিন্তু আন্তরিক উষ্ণতা আছে। সেইসব পকেটে পুরেই ক্রিস গেইল ধীরে ধীরে হেঁটে গেছেন প্যাভিলিয়নের দিকে। ড্রেসিংরুমে ঢোকার আগে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়েছেন হেলমেট। জার্সির গায়ে লেখা ৩০১। তাঁর একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের সংখ্যা।

শেষ ম্যাচেও কিন্তু ভারতীয় বোলারদের দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছেন গেইল। ৪১ বলে ৭২ রানের ঝোড়ো ইনিংসে বল গ্যালারিতে উড়ে গেছে পাঁচ-পাঁচবার। একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে সাড়ে দশ হাজারের বেশি রান তাঁর, ক্যারিবিয়ানদের মধ্যে সর্বাধিক। টেস্টে দুটি ত্রিশতরানের মালিক। আর টি-টোয়েন্টিতে তো তিনি যাকে বলে দৈত্য। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে প্রথম শতরানের মালিক তিনিই। একই দিকে হালের পাওয়ার হিটিং, ধুমধাড়াক্কা ক্রিকেট-যুগের স্বাভাবিক প্রতিনিধি হয়েও তিনি ক্রিকেট-প্রেমীদের নস্টালজিয়ার সামগ্রী। ঘোর দুঃসময়েও যাঁর ব্যাটিং তাণ্ডব দেখে রিচার্ডস, লয়েডদের শাসন মনে পড়ে গেছিল অজি কিংবদন্তি স্টিভ ও-র। দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম সেরা বোলার পোলক বলেছিলেন, গেইল আসলে ক্যারিবিয়ান গৌরবের শেষ প্রতিনিধি। আর, আমরা সবাই জানি, গেইল প্রকৃত অর্থে একজন চিরবিস্ময়, চির-রোমাঞ্চ। তাঁকে অপছন্দ করে থাকা যায় না।

ক্যারিবিয়ান জার্সিতে তাঁর কেরিয়ার আরো দীর্ঘ হতে পারত। আন্তর্জাতিক রান বাড়তে পারত আরো হাজার পাঁচেক। কিন্তু, গেইল মাঝে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে ঝামেলায় জড়ালেন। কখনো খেলেন, কখনো খেলেন না। তাঁর মর্জি মেনে চলাও হয়তো কঠিন। ২০১৫ বিশ্বকাপে টানা ব্যর্থ। নির্বাচক প্রধান বললেন, গেইলের অবসর নেওয়া উচিত। পরের ম্যাচেই ডবল সেঞ্চুরি। ম্যাচের পরে নির্বাচক প্রধানকে ‘বোকা’ বললেন গেইল। তিনি ‘ইউনিভার্সাল বস’, তাঁকেই এসব মানায়। তিনি থাকা মানেই টিকিট বিক্রি বেড়ে যাওয়া, মৃতপ্রায় টিআরপি দ্রুত বাড়িয়ে নেবে রানরেট। তিনি থাকা মানেই ঘোর লেগে থাকা। কোমর ঘোরে না, দৌড়তে চান না মোটে অলস মানুষটি। কিন্তু ব্যাটে-বলে হলে বোঝা যায়, রাজত্ব কাকে বলে! গেইল সত্যিই জানেন, ‘মেজাজটাই আসল রাজা’।

সেই মেজাজটা নিয়েই আজ সরে গেলেন ক্যারিবিয়ান দৈত্য। ক্রিকেট তাঁর অন্যতম সেরা এক চরিত্রকে হারাল। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট আরো খানিক বর্ণহীন হল। কত স্মৃতি, বিস্ময়, মুগ্ধতাকে পিছনে রেখে প্যাভিলিয়নে ঢুকে গেলেন মানুষটি। দৈত্যের মতো বিরাটকায়। সাম্রাজ্য যতই ভঙ্গুর হোক, রাজারা তো রাজাই হন ক্রিস। আপনার থেকে ভালো তা আর কে জানবে!