৪০ বছর ধরে সেল্ফ কোয়ারেন্টাইন, এক আশ্চর্য রুশ পরিবারের কাহিনি

পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা কত? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে অবশ্যই কিছু জনগণনা সমীক্ষার রিপোর্টের সাহায্য নিতে হবে। বিভিন্ন দেশের সরকার নির্দিষ্ট সময় পরপর যেসব সমীক্ষা করে থাকে। কিন্তু তাতেও কি সমস্ত মানুষের হদিশ পাওয়া যায়? বিশেষ করে সেই মানুষ যদি নিজেই নিজেকে আড়াল করে রাখে! না, কোনো অপরাধী বা সমাজবিরোধী নয়। নিছক একটি বিশ্বাসের তাড়নায় সভ্য জগৎ থেকে দূরে সরে থাকে কেউ কেউ। ধরা যাক এই রাশিয়ান পরিবারটির কথা।

১৯৭৮ সালে গ্যালিনা পিসমেনস্কায়ার নেতৃত্বাধীন ভূতাত্ত্বিক দলটি রাশিয়া-মঙ্গোলিয়া সীমান্ত অঞ্চলে পৌঁছে রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়েছিল। হেলিকপ্টার থেকে যখন তারা নিরাপদ একটা আশ্রয় খুঁজছিল, তখনই চোখ পড়ে জনহীন তৈগা বনভূমির মাঝে একখণ্ড মানুষের তৈরি বাগান। তার ধার দিয়ে চলে গিয়েছে পায়ে হাঁটা একটি রাস্তা। কৌতূহল দমন করতে পারেননি পিসমেনস্কায়া। অভিযাত্রী দলটিকে নিয়ে নেমে পড়লেন সেখানেই। আর তার আগে কেউ আদৌ খবরই রাখতেন না বুড়ো কার্প লাইকোভ আর তার দুই মেয়ের।

বুড়ো লাইকোভ একসময় জওয়ান ছিলেন। তখন তিনিও থাকতেন অন্যান্য সভ্য মানুষদের মাঝখানেই। আর রাশিয়া জুড়ে তখন চলছে এক বিরাট পটপরিবর্তন। ইতিহাসে যাকে বলে সোভিয়েত বিপ্লব। সোভিয়েত বিপ্লবের ফলে রাশিয়ার মানুষের মধ্যে অনেক বৈপ্লবিক পরিবর্তন তো ঘটেছিলই। তবে সেইসঙ্গে বহু মানুষকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল তাদের দীর্ঘদিনের ধর্মবিশ্বাস। অথবা নাস্তিক সোভিয়েত সেনার হাতে ঘটেছিল মৃত্যু। লাইকোভের দুই ভাইও যখন একইভাবে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে গেলেন, তখন সভ্য জগৎ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন লাইকোভ। চলে এলেন সাইবেরিয়ার বনভূমির মাঝে জনহীন তৈগা অঞ্চলে। তারপর সেখানেই কেটেছে দীর্ঘ জীবন।

মানুষের থেকে আলাদা হয়ে ওল্ড বিলিভার খ্রিস্টান লাইকোভ চলে এসেছিলেন ১৯৩৬ সালে। তারপর সেখানেই জন্ম হয়েছে দুই মেয়ের। তারা পড়াশুনাও শিখেছে সেখানেই। পড়তে শিখেছে লাইকোভের সঙ্গে নিয়ে আসা বাইবেল এবং অন্যান্য ধর্মীয় পাঠ্যপুস্তক। নিজের পরিবারের বাইরে অন্য কোনো মানুষের মুখ দেখতে চাইতেন না তাঁরা। তবে জঙ্গলের মধ্যে হাজার প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা তো সহজ নয়। ফলে একদিন চরম শৈত্যপ্রবাহে প্রাণ হারালেন বুড়ো লাইকোভ। রাশিয়ার সেনাবাহিনী ততদিনে তাঁদের খবর পেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু শহরে এনে চিকিৎসা করিয়েও তাঁকে বাঁচানো গেল না। তবে মেয়ে আগাফিয়া সুস্থ হয়ে আবার ফিরে গেলেন জঙ্গলেই। সেটা ১৯৮১ সাল। তারপর থেকে এই চার দশক সেখানেই আছেন তিনি। গতবছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাঁর জীবিত থাকার খবর পাওয়া গিয়েছে। তবে সভ্য জগতের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই এই ওল্ড বিলিভার পরিবারটির।

Powered by Froala Editor