১৮৬৪ সালের সাইক্লোনে তছনছ বাংলা, মৃত ৬০ হাজার; ভেসে গিয়েছিল কলকাতাও

ঠিক এক বছর আগের কথা। মে মাসেই বাংলার বুকে আছড়ে পড়েছিল আমফান। সুন্দরবন তো বটেই, দক্ষিণবঙ্গের সমস্ত জেলাকেই সম্পূর্ণ তছনছ করে দিয়েছিল সেই বিধ্বংসী সুপার সাইক্লোন। এবার করোনা পরিস্থিতিতে আবারও শিয়রে হাজির আরও একটি ঘূর্ণিঝড়, ইয়াস।  

এমন পরিস্থিতিতে আরও একটু পেছনে ফেরা যাক। বাংলার ওপর দিয়ে এর আগেও অনেক ঝড় বয়ে গেছে। কখনও আন্দোলনের ঢেউ, বিপ্লবের ধ্বনি, আবার স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা বললে আমফানের পূর্বসূরির দিকেও চোখ ফেরানো দরকার। আজ যেমন একটি সুপার সাইক্লোন ধেয়ে আসছে বঙ্গে; ঠিক তেমনই ১৫৬ বছর আগেও একটি ঝড় কলকাতাকে তছনছ করে দিয়ে চলে গিয়েছিল। ইতিহাসের হাজার ঘটনায় চাপা পড়ে গেলেও, আজ একবার সেই দিনটিকেও স্মরণ করা যাক…

সাল ১৮৬৪। দিনটি ছিল ৫ অক্টোবর। অন্যান্য দিনের মতোই চলছিল বাংলার জীবন। কয়েক বছর আগেই সিপাহিদের দমন করেছে ব্রিটিশরা। নিজেদের সাম্রাজ্যও কায়েম করেছে। কলকাতা তখন স্বপ্নের শহর। নতুনভাবে একে তৈরি করছে সাহেবরা। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বন্দরও বটে। কলকাতার আশেপাশেও তৈরি হল বেশ কিছু বন্দর এলাকা। যার অন্যতম হল খেজুরি। ৫ অক্টোবরের ভোরের দিকে হঠাৎই সমস্ত কিছু থমথমে হয়ে যায়। ঘণ্টাখানেক সবকিছু চুপচাপ ছিল; দুর্যোগের আগে যেমন শান্ত হয়ে যায় সবটা। তারপরই শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি। সঙ্গে ঝড়। আবারও সবকিছু থেমে গেল। সকাল এগারোটা নাগাদ ধেয়ে এল ভয়ানক সাইক্লোন। সমস্ত কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। জাহাজ, নৌকা সব কোথায় ভেসে গেল কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।

সেই দিনের যেটুকু বর্ণনা পাওয়া যায়, তা পড়লে রীতিমতো শিহরণ খেলে যাবে। সেই সময়ের বেঙ্গল এডমিনিস্ট্রেটিভ রিপোর্ট অনুযায়ী, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার খেজুরি, কৌখালির মতো জায়গায় ১৩ ফুট উঁচু ঢেউ উঠেছিল! শুধু গ্রাম বাংলা নয়, কলকাতাও ভেসে গিয়েছিল। যেদিকে তাকানো যায়, শুধু ধ্বংসের চিহ্ন। সবাই ঘরবন্দি; তবে ১৮৬৪-এর সেই সময় গ্রামগুলোর ঠিক কী পরিস্থিতি হয়েছিল, ভাবতেও শিহরণ খেলে যায়। এখনকার মতো উন্নত আবহাওয়া ব্যবস্থা ও যোগাযোগ মাধ্যমও ছিল না। কাজেই আগে ভাগে প্রস্তুতির খুব একটা উপায় ছিল না। রিপোর্ট অনুযায়ী, অন্তত ৬০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল সেই সাইক্লোনে। সরকারি হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৯৯ হাজার ২০০ টাকা (তখনকার হিসেবে)। এর বাইরে ক্ষতির পরিমাণ ছিল আরও বহুগুণ। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় হিজলি আর খেজুরি বন্দর। সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় এই দুটি জায়গা। প্রচুর মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে যায়। একপ্রকার থেমে যায় জনজীবন।

তারপর আরও অনেক ঝড় ছুঁয়ে গেছে বাংলায়। চাক্ষুষ করেছে কলকাতা। আর আজ দোরগোড়ায় ইয়াস। আমফানের মতো ভয়ঙ্কর রূপ না নিলেও বাংলার ক্ষতিসাধন করতে যে যথেষ্ট সমর্থ সে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। সমস্ত ঝাপটা সহ্য করে কলকাতা হয়ত ১৫৭ বছর আগের সেই অক্টোবরের দিনটিকেও আবার মনে করছে। এতকিছু পেরিয়ে এসেছি যখন, এটাও সামলে নেওয়া যাবে সবাই মিলে!

ছবি ঋণ - The Illustrated London News, November 26, 1864.

Powered by Froala Editor