নগ্ন শরীরকে ক্যানভাস বানিয়ে শতাব্দীর সবচেয়ে ‘সমালোচিত’ শিল্পী ক্যারোলি

‘এমটিভি ভিডিও মিউজিক অ্যাওয়ার্ড’-এর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। গম গম করছে সভাগৃহ। এমন সময় মঞ্চে উঠে এলেন লেডি গাগা। পরনে অদ্ভুত এক পোশাক। কাপড় নয়, সে-পোশাক তৈরি কাঁচা মাংস দিয়ে। দর্শকরা তো বটেই, এই দৃশ্য চমকে দিয়েছিল খোদ সাংবাদিকদেরও। ২০১০ সালের এই ঘটনার সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচিত সকলেই। তবে মজার বিষয় হল, এই আশ্চর্য ‘স্টান্ট’-এর জন্য লেডি গাগার অনুপ্রেরণা ছিলেন অন্য এক মার্কিন নারী। যিনি প্রচলিত চিন্তাধারার দেওয়াল ভেঙে বার বার ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছিলেন শিল্পকে।

ক্যারোলি স্নিম্যান (Carolee Schneemann)। নামটা শোনেননি নিশ্চয়ই? চিত্রশিল্পের (Art) দুনিয়ায় আজকের দিনে অন্যতম জনপ্রিয় ফর্ম বডি পেইন্টিং (Body Painting)। সেই বডি পেইন্টিং-কেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিলেন ক্যারোলি। মাল্টিমিডিয়া, পারফরম্যান্স আর্ট এবং নিজের শরীরের ব্যবহারেই ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন নারীবাদকে। 

১৯৩৯ সালে ফিলাডেলফিয়ার প্রান্তিক অঞ্চলে জন্ম ক্যারোলির। বাবা ছিলেন চিকিৎসক। ফলে, কিশোর বয়স থেকেই শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা জন্মেছিল তাঁর। আরেকটু বড়ো হওয়ার পর ধরলেন পেন্সিল, রং-তুলি। মানবদেহকেই ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে কাগজে ফুটিয়ে তোলাই যেন নেশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ক্যারোলির। অবশ্য তার জন্য শাস্তিও কম ভোগ করতে হয়নি। ড্রইং বুকে নগ্ন মহিলা প্রতিকৃতি আঁকার জন্য বহিষ্কার হতে হয়েছিল স্কুল থেকে। তবে ক্যারোলিকে অবাক করে অন্য একটি ঘটনা। এই একই স্কুলে সমবয়সী পুরুষ শিল্পীদের জন্য মডেল হিসাবে নগ্ন হয়ে তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে হলেও, তাতে বিন্দুমাত্র আপত্তি ছিল না স্কুল কর্তৃপক্ষের। 

বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল সেখান থেকেই। খানিক জেদের বশেই আর্টকে বেছে নেন কলেজের প্রধান বিষয় হিসাবে। তবে সেখানেও বৈষম্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিল্পের যে ইতিহাস পড়ানো হয়, সেখানে কোনো নারী শিল্পীর উল্লেখ নেই! অথচ, নগ্ন নারীদেহের প্রতিকৃতি অঙ্কন কিংবা মডেল-এর ওপর রয়েছে পৃথক পৃথক অধ্যায়। আর্টের সিলেবাসের এই দ্বিচারিতা রীতিমতো আশ্চর্য করেছিল ক্যারোলিকে। 

এই পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধেই নিজের দেহকে ক্যানভাস করে নেন ক্যারোলি। নগ্নগাত্রে রং-এর পরত, দেওয়ালে অজস্ত্র এলোমেলো আঁকিবুঁকি। আর সেই দেওয়ালের সামনে, ছাদ থেকে দড়ি বাঁধা অবস্থায় ঝুলছেন ক্যারোলি। ষাটের দশকে শিকাগোয় আয়োজিত চিত্রপ্রদর্শনীতে এমনই আশ্চর্য অবস্থায় দেখা যায় তাঁকে। যা রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা বিশ্বে। 

এখানেই শেষ নয়, এরপর থেকে ক্রমাগত প্রচলিত ধারণাকে আঘাত করে গেছেন মার্কিন শিল্পী। কখনো কাঁচা মাছ, মুরগি কিংবা মাংসের পরতকেই করে নিয়েছেন লজ্জাবস্ত্র, কখনও আবার নিজের যৌনমিলনের দৃশ্যকেই ক্যামেরাবন্দি করেছেন ছবি আঁকা লেন্সের মধ্যে দিয়ে। আবার ১৯৭৭ সালে মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দেওয়ার সময়, দর্শকদের সামনেই নিজের যোনির ভিতর থেকে বার করে এনেছেন স্ক্রিপ্ট। 

স্বাভাবিকভাবেই বিতর্কও তাঁকে নিয়ে কম হয়নি। সমালোচনার ঝড় উঠেছিল তৎকালীন মিডিয়ায়। কখনও আবার তাঁকে হত্যার চেষ্টাও করা হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত জয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছিলেন ক্যারোলি। সেটা নারীবাদের প্রেক্ষিতেই হোক কি প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার মানুষের অধিকার বা যুদ্ধ-বিরোধিতা— প্রতিটা ক্ষেত্রেই বার বার আঘাত হেনেছেন তিনি। মানুষকে অভ্যস্ত করে তুলেছেন ‘এরোটিক’ বা নগ্নতার সঙ্গে, বাস্তবতার সঙ্গে। লড়েছেন পর্ন কিংবা নগ্ন মডেলিং-এর সঙ্গে জড়িত শিল্পীদের সম্মানের জন্যও। 

তৎকালীন সময়ে ক্যারোলির কাজ সর্ব্বজনবিধিত না হলেও, চলতি দশকের শুরুতে তাঁর আঁকা ছবি, তথ্যচিত্র কিংবা মাল্টিমিডিয়া অনুস্থাপনা নিয়ে শুরু হয় বিস্তারিত গবেষণা। ২০১৭ সালে ভেনিস বায়ানালে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট তথা ‘গোল্ডেন লায়ন’ পুরস্কারও দেওয়া হয় তাঁকে। তার ঠিক ২ বছর পরই, ২০১৯ সালে প্রয়াত হন কিংবদন্তি তথা বিশ শতকের সবচেয়ে ‘সমালোচিত’ শিল্পী। তবে আজও হাজার হাজার তরুণ মহিলা শিল্পীদের অনুপ্রেরণা ক্যারোলি। তাঁর ওপর বিস্তারিত গবেষণা, আগামীতে কমিয়ে আনবে লিঙ্গবৈষম্যের ব্যবধান, তাতে সন্দেহ নেই কোনো…

Powered by Froala Editor