ভিক্ষুক থেকে ভারতের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের চিত্রসাংবাদিক— এক রূপকথার কাহিনি

বছর কয়েক আগেও মুম্বাইয়ের লোকাল ট্রেনে ভিক্ষা করেই দিন কাটত তাঁর। তারপর লকডাউন। আরও সংকটময় হয়ে উঠেছিল পরিস্থিতি। বন্ধ হয়ে গেছিল উপার্জনের সেই পথটুকুও। তবে কথায় আছে না, সংকটই মানুষকে সমাধানের পথ দেখায়। জোয়া থমাস লোবোর (Zoya Thomas Lobo) ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমনই। মহামারীই সম্পূর্ণভাবে বদলে দিয়েছিল তাঁর জীবন। হাজার প্রতিকূলতাকে হারিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন ভারতের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের চিত্রসাংবাদিক (Photojournalist)। 

তবে এই গল্পের শুরু আজ থেকে প্রায় বছর কুড়ি আগে। মাত্র পাঁচ বছর বয়স তখন জোয়ার। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হওয়ায় স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন জোয়া। কিন্তু তাঁর অপরাধ ঠিক কী— তা তখন বুঝতে পারেননি তিনি। দশ-এগারো বছর বয়সে ধীরে ধীরে বিষয়টা স্পষ্ট হয় তাঁর কাছে। বুঝতে পারেন, খাতায়-কলমে তিনি পুরুষ হলেও, আর পাঁচজনের থেকে তিনি আলাদা। সে-সময় তাঁর পরিচয় গোপন রাখতে একাধিকবার বাসাবদলও করেছিলেন তাঁর মা। 

অবশ্য বৃথা গিয়েছিল এই চেষ্টা। কিছুদিনের মধ্যেই পাড়া-প্রতিবেশিদের কাছে পৌঁছে যায় খবরটা। তারপর ক্রমাগত হেনস্থার সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে। রেহাই পাননি পরিবার-পরিজনরাও। ১৭ বছর বয়সে তাই বাধ্য হয়েই বাড়ি ছাড়েন জোয়া। যোগ দেন প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষদের একটি স্থানীয় সংগঠনে। শুরু হয় তৃতীয় লিঙ্গ মানুষের পরিচয় ও অধিকার আদায়ের লড়াই। ইচ্ছে ছিল একদিন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাও দেবেন তিনি। কিন্তু তার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন। বাধ্য হয়ে তাই ‘মাঙতি’-র পথে পা দেওয়া, ট্রেনে-বাসে ভিক্ষা করাকেই পেশা হিসাবে বেছে নেওয়া। 

এরপর লকডাউন খানিকটা শাপে বর হয়েই হাজির হয়েছিল তাঁর কাছে। একদিকে যখন বন্ধ হয়ে যায় উপার্জনের পথ, তখন তাঁর কাছে অনুরোধ আসে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করার। ‘হিজড়া— শ্রাপ কি বরদান’— ছবিতে প্রধান চরিত্রের ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল তাঁকে। এই ছবির জন্য যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছিলেন জোয়া। আর এই ছবির সূত্র ধরেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় মুম্বাই-এর প্রথম সারির একটি সংবাদপত্রের সম্পাদকের সঙ্গে। ইংরাজি ভাষায় দক্ষতা এবং ইতিহাসে জ্ঞানের জন্য সাংবাদিকের চাকরিও জুটে যায় জোয়ার। 

তবে সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি। বরং, লেখালিখির পাশাপাশি শুরু হয় ফটোগ্রাফি। সেই লড়াইটাও সহজ ছিল না মোটেই। প্রেস কার্ড থাকলেও, তখন যে কোনো সঞ্চয়ই নেই তাঁর। ফলে, ক্যামেরা কেনার জন্যও সে-সময় ট্রেনে-বাসে ভিক্ষা করতে হয়েছে তাঁকে, সাহায্যের জন্য দ্বারস্থ হতে হয়েছে মানুষের কাছে। সেইসঙ্গে ছবি তোলার দক্ষতায় শান দিতে বেশ কিছু অনলাইন কোর্সেও নাম নথিভুক্ত করেন। লকডাউনের সময় পথে নেমে মেহনতি মানুষ, প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের দুর্দশার ছবি ক্যামেরাবন্দি করেন জোয়া। হয়ে ওঠেন দেশের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের চিত্রসাংবাদিক। মুম্বাই-এর একাধিক সংবাদপত্র ও ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা এবং ছবি। বিশেষত বান্দ্রা স্টেশনে তাঁর তোলা পরিযায়ী শ্রমিকদের বিক্ষোভের ছবি রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল দেশজুড়ে। এই ছবির জন্য একাধিক সম্মাননাও পেয়েছিলেন জোয়া। 

মহামারীর দিন শেষ হয়েছে। আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে জীবন। তবে অভ্যাস বদলায়নি জোয়ার। আজও সমাজের নিচুতলার মানুষদের জীবনই তাঁর চিত্রসাংবাদিকতার প্রধান বিষয়। মুম্বাই-এর অপরাধ জগৎ নিয়েও ধারাবাহিকভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন জোয়া। সঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের এগিয়ে নিয়েও যাওয়া, সমাজের মূল স্রোতে হাজির করাও অন্যতম লক্ষ্য তাঁর। চলছে সেই লড়াই-ও। মুম্বাই তো বটেই, দেশের একাধিক শহরে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করে চলেছেন জোয়া। অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলেছেন হাজার হাজার প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষকে…

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More