ফিরোজ শাহ কোটলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশেই লুকিয়ে তুঘলক আমলের প্রত্নক্ষেত্র!

ফিরোজ শাহ কোটলার প্রসঙ্গ আসলেই, চোখের সামনে ভেসে ওঠে ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ছবি। এমনকি দিল্লির স্থানীয় মানুষদেরও ফিরোজ শাহ কোটলার কথা জিজ্ঞেস করলে স্টেডিয়ামের গেটেরই দিক নির্দেশ করবেন। তবে এই একই নামে আরও একটি ঐতিহাসিক প্রত্নক্ষেত্র লুকিয়ে রয়েছে দিল্লির (Delhi) বুকেই। আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে ফিরোজ শাহ কোটলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ঠিক গা ঘেঁষেই।

হ্যাঁ, খানিক আশ্চর্য লাগলেও সত্যি। আদতে ফিরোজ শাহ কোটলা (Feroz Shah Kotla) স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে তুঘলক বংশের তৃতীয় সম্রাট ফিরোজ শাহ তুঘলকের নামানুসারে। তবে ‘কোটলা’ শব্দটির অর্থ হল দুর্গ। ফিরোজ শাহ তুঘলকের তৈরির ‘কোটলা’ বা দুর্গের (Fort) পাশেই অবস্থিত হওয়ায় স্টেডিয়ামের নাম রাখা হয় ফিরোজ শাহ কোটলা। তবে ভারতের অন্যতম ঐতিহাসিক প্রত্নক্ষেত্র হওয়া সত্ত্বেও, প্রাচীন এই দুর্গের অবস্থান কিংবা ইতিবৃত্ত জানেন না অধিকাংশ মানুষই। 

পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় সাড়ে ছ’শো বছর। ১৩৫১ সাল। দিল্লির সিংহাসনে বসেন ফিরোজ শাহ। রাজ্যাভিষেকের পরই যমুনার পশ্চিম তীরে প্রকাণ্ড এক দুর্গ নির্মাণের নির্দেশ দেন তিনি। কারণ, পূর্ববর্তী তুঘলক শাসকদের তৈরি চারটি দুর্গই ছিল যমুনার পূর্বপ্রান্তে। পাশাপাশি নদী থেকে তাদের দূরত্বও ছিল বেশ খানিকটা। ফলে, জলের সমস্যা দেখা দিত হামেশাই। তাই বাসস্থান বদলের সিদ্ধান্ত। দিল্লির খ্যাতনাম ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ছায়ায় লুকিয়ে থাকা ভগ্নপ্রায় ফিরোজ শাহ কোটলাই হল সেই দুর্গ। ১৩৫৪ সালে এই দুর্গেই স্থানান্তরিত হন ফিরোজ শাহ। এমনকি এই দুর্গকেই কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে নতুন রাজধানী। ফিরোজাবাদ। অন্যদিকে পরিত্যক্ত হয় পূর্ববর্তী শাসক মহম্মদ বিন তুঘলকের তৈরি রাজধানী তুঘলকাবাদ। 

অবশ্য, রাজত্বকাল খুব একটা সুখকর ছিল না ফিরোজ শাহের। কারণ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ততদিনে শুরু হয় বিদ্রোহ। সেইসঙ্গে ক্রমশ বাড়তে থাকে বহির্শক্তির হানার আশঙ্কা। তবে এসবের মধ্যেও দিল্লিকে সাজিয়ে তোলেন ফিরোজ শাহ। ফিরোজাবাদ সংলগ্ন অঞ্চলে তৈরি করেন একাধিক জনপদ। তৈরি করেছিলেন ৪০টি মসজিদ, ৩০টি জলাধার, ৫০টি বাঁধ, বহু সেতু এবং শতাধিক হাসপাতাল। সংস্কার করেন কুতুব মিনারের। তাছাড়া ফিরোজাবাদকে সাজাতে আম্বালায় স্থাপিত সম্রাট অশোকের স্তম্ভও উপড়ে আনেন ফিরোজ শাহ। স্থাপন করেন ফিরোজ শাহ কোটলার নিকটবর্তী অঞ্চলে। 

তবে ফিরোজ শাহের এই সাজানো স্বপ্নরাজ্য ভেঙে পড়ে তাঁর মৃত্যুর পরই। নেপথ্যে মোঙ্গল সেনাধ্যক্ষ তৈমুর লং। ১৩৯৮ সালে দিল্লি আক্রমণের সময় তৈমুরেরই হাতেই ধ্বংস হয় প্রাচীন দুর্গটি। অবশ্যি ফিরোজ শাহ কোটলা দুর্গের প্রাঙ্গণে অবস্থিত দুর্গটি ধর্মীয় কারণেই রক্ষা পায় তৈমুরের হাত থেকে। কথিত আছে, এই মসজিদই ছিল নাকি এ-দেশে তাঁর প্রার্থনার জায়গা। আজও যা দাঁড়িয়ে রয়েছে অক্ষতভাবেই। অন্যদিকে মূল দুর্গটি পরিণত হয়েছে ভগ্নস্তূপে। 

মজার বিষয় হল, অধিকাংশ দিল্লিবাসীর ক্ষেত্রেই ফিরোজ শাহের এই প্রত্নক্ষেত্র কিংবা তার ইতিহাস অজ্ঞাত থাকলেও, প্রতিদিন কয়েকশো মানুষ হাজির হন এই দুর্গের ভগ্নস্তূপে। না, ইতিহাস অন্বেষণে নয়, বরং জিনের সন্ধানে। হ্যাঁ, অনেকের বিশ্বাস, এই দুর্গের ভগ্নস্তূপেই নাকি বাস করে অলৌকিক ক্ষমতাশালী জিনরা। জিন বলতে এক বিশেষ ধরনের প্রেতাত্মা আরকি। বিশ্বাস, তাদের কাছে দুঃখ-যন্ত্রণার কথা লিখে চিঠি পাঠালে নাকি সৌভাগ্য ফেরে। আর সেই কারণেই পরিত্যক্ত ‘কোটলা’-তে ভিড় জমান মানুষরা। অবশ্য এই রীতিকে খুব একটা প্রাচীন বলা চলে না। কারণ, ভারতে ইমার্জেন্সি শেষ হওয়ার পর, অর্থাৎ ১৯৭৭ সালের পর থেকেই শুরু হয়েছিল এই আশ্চর্য রীতি। সে-সময় চাকরির অনুসন্ধানে দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন বহু দরিদ্র মানুষ। তাঁদের মধ্যেই ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে পরিত্যক্ত দুর্গের এই অলৌকিক ক্ষমতা ও জিনের কাহিনি।

উল্লেখ্য, ফিরোজ শাহ কোটলা দুর্গের প্রাঙ্গণে গেলে এখনও দেখা মিলবে প্রাচীন খিলান, গেট এবং দেওয়ালের কিছু অংশ। দেখা যাবে ফিরোজ শাহ তুঘলকের নির্মিত পিরামিডের ভগ্নস্তূপ। তাছাড়া এই দুর্গের প্রাঙ্গণেই রয়েছে দিল্লির একমাত্র বৃত্তাকার বাওলি। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের তালিকায় এই দুর্গ থাকলেও, তা আলাদা করে রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি আজও। বলাই বাহুল্য, সেই পদক্ষেপ নেওয়া হলে এই পরিত্যক্ত দুর্গের ধ্বংসাবশেষও হয়ে উঠতে পারে দিল্লির অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র…

Powered by Froala Editor

More From Author See More