মিশরের উপকণ্ঠে জনহীন দেশ, ‘মিডল আর্থ’-এর স্বঘোষিত রাষ্ট্রনায়ক এক ভারতীয়!

যত দূর দেখা যায় শুধু বালি আর বালি। মাঝে মধ্যে মাথা উঁচু করে রয়েছে গ্রানাইটের দু-একটি ছোট্ট টিলা। মিশর এবং সুদানের অবস্থিত এই মরু-অঞ্চলে জনবসতি নেই কোনো। বলতে গেলে, আক্ষরিক অর্থেই এই অঞ্চল নো-ম্যানস ল্যান্ড। তবে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক দ্বন্দ্বের জন্য যে ফাঁকা পড়ে রয়েছে এই অঞ্চল, তেমনটা নয় একেবারেই। বরং, এই অঞ্চলটিকে নিজেদের রাষ্ট্রের পরিধিতে সংযুক্ত করতে ইচ্ছুক নয় দুই রাষ্ট্রই। তবে কার হাতে রয়েছে এই অঞ্চলের প্রশাসনিক দায়িত্ব?

এক ভারতীয়ের। উত্তর শুনে অবাক লাগছে নিশ্চয়ই? হ্যাঁ, এই রাজ্যের স্বঘোষিত প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় আইটি উদ্যোগপতি স্যায়াস দীক্ষিত, এবং রাষ্ট্রপতি তাঁর বাবা! স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এভাবেই কি নিজেকে কোনো দেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা যায়? আর স্যায়াসের এই দাবি নিয়ে কোনো প্রশ্নই বা তোলেনি কেন মিশর এবং সুদান? 

এই উত্তর পেতে ফিরে যেতে হবে ১২০ বছর। উনিশ শতকের শেষের দিক সেটা। তখনও পর্যন্ত সুদান (South Sudan) এবং মিশর (Egypt) উভয় রাষ্ট্রেই ব্রিটিশ শাসন। ১৯২২ সালে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পায় মিশর। তবে তার দু’দশক আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল পৃথক রাষ্ট্রগঠনের প্রস্তুতি। ব্রিটিশ সরকারই তৈরি করে দিয়েছিল মিশর এবং দক্ষিণ সুদানের মানচিত্র। 

ঠিক যেভাবে ভারতবর্ষকে ভাগ করেছিল ব্রিটিশ শক্তি, অনেকটা সেভাবেই প্রস্তুত করা হয়েছিল এই মানচিত্রটিও। অর্থাৎ, জনবসতি এবং উপজাতি জনঘনত্বের ওপর ভিত্তি করেই ঠিক করা হয়েছিল দেশের সীমানা। কিন্তু জনবসতিহীন হওয়ায় দুই রাষ্ট্রের মধ্যেই অন্তর্গত করা হয়নি দুটি পৃথক পৃথক অঞ্চলকে। আমরা যে আশ্চর্য ‘স্বনির্মিত’ রাষ্ট্রের কথা বলছি, সেই এই দুটির মধ্যে একটি অঞ্চল। যা তৎকালীন সময়ে পরিচিত ছিল ‘বির তাউয়িল’ (Bir Tawil)নামে। ‘হালাই-ব ট্রাইঅ্যাঙ্গেল’-খ্যাত দ্বিতীয় অঞ্চলটি ছিল লোহিত সাগরের ঠিক পাশেই। 

‘হালাই’ব ট্রাইঅ্যাঙ্গেল’ সমুদ্রের তীরে অবস্থিত হওয়ায়, বাণিজ্যগত সুবিধার কথা ভেবে স্বাধীনতা অর্জনের পরই জনশূন্য এই প্রান্তরের দাবিতে সরব হয় মিশর। অথচ, ‘বির তাউয়িল’ ভূখণ্ড-ঘেরা জমি বা ল্যান্ডলকড কাউন্টি হওয়ায় সুদান কিংবা মিশর কেউ-ই দাবি জানায়নি এই অঞ্চলের। অন্যদিকে খোদ ব্রিটেনও খুব একটা আগ্রহী ছিল না ‘বির তাউয়িল’ নিয়ে। 

২০১৪ সালে মার্কিন নাগরিক জেরেমিয়া হিটন মিশর ভ্রমণে গিয়ে জানতে পারেন এই অঞ্চলটির কথা। আর তার ঠিক পরেই নতুন রাষ্ট্র তৈরির নেশায় তড়িঘড়ি নতুন পতাকা তৈরি করেই পাড়ি দেন বির তাউয়িলে। ১৪ ঘণ্টার দুঃসাহসিক অভিযানের পর মরুভূমির বুকে নিজের তৈরি পতাকা স্থাপন করে ‘সার্বভৌম রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করেন বির তাউয়িলে। ঘোষণা করেন, তিনিই এই অঞ্চলের সম্রাট এবং তাঁর ৬ বছর বয়সি মেয়ে রাজকন্যা। 

এর ঠিক বছর তিনেক বাদেই বির তাউয়িল ‘অধিগ্রহণ’ করেন স্যায়াস দীক্ষিত। নিজের তৈরি পতাকা উত্তোলন করে তিনিও প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঘোষণা করেন নিজেকে। সঙ্গে ‘ঐতিহাসিক’ এই ঘটনার উদযাপন করতে সূর্যমুখী বীজও রোপণ করেছিলেন তিনি। তাঁর এই কর্মকাণ্ডের কথা জানতে পারার পরেই সরব হন পূর্বোক্ত ‘সম্রাট’ হিটন। উত্তপ্ত বাক্যালাপ, টুইট-যুদ্ধ চলেছিল বেশ কিছুদিন ধরে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত থিতিয়ে পড়ে এই বিবাদ। বরং, দুই ব্যক্তিই যৌথ শাসনের জন্য রাজি হন। 

এর কিছুদিন পরেই রুশ নাগরিক দিমিত্র ঝিখারেভ দাবি করেন, তিনিই এই অঞ্চলের প্রথম সম্রাট। ২০১৪ সালে হিটনের আগেই নাকি ‘সাম্রাজ্য’ স্থাপন করেছিলেন তিনি। এমনকি এই রাজত্বের নাম দিয়েছিলেন ‘মিডিয়া টেরা’। ইংরাজিতে যার অর্থ ‘মিডল আর্থ’। হ্যাঁ, লর্ড অফ দ্য রিংস-এর সেই ‘মিডল আর্থ’-এর অনুকরণেই। 

তারপর পেরিয়ে গেছে আরও পাঁচ পাঁচটি বছর। কিন্তু বিতর্ক থামেনি ‘মিডল আর্থ’-এর মালিকানা নিয়ে। অবশ্য তিন ‘রাষ্ট্রনায়ক’-এর এই লড়াই-এ ঘুণাক্ষরেও পাত্তা দেয়নি জাতিসংঘ। এই বিবাদে অংশ নেয়নি মিশর কিংবা সুদানও। প্রশ্ন থেকে যায়, আদৌ কি কোনোদিন ২০০০ বর্গ কিলোমিটারের এই বিপুল অঞ্চল স্বাধীন দেশ কিংবা রাজত্বের স্বীকৃতি পাবে কোনোদিন? জানা নেই সেই উত্তর। কারণ, একক উদ্যোগে তো আর রাজত্ব গড়ে তোলা যায় না। তা রক্ষার জন্য প্রয়োজন সামরিক বাহিনীর। আর সেটা না থাকলে, বছর বছর হাত বদল হতেই থাকবে রাষ্ট্রের…

Powered by Froala Editor

More From Author See More