জন্ম ৩৩০০ বছর আগে! বিশ শতকের ‘জাতিস্মর’ ডরোথির গল্প হার মানায় সিনেমাকেও

গতজন্মের স্মৃতিকে পাথেয় করেই গুপ্তধনের সন্ধান দিয়েছিল মুকুল। ‘সোনার কেল্লা’-র এই গল্প কার-ই না অজানা? শুধুই কি মুকুল? ভারতীয় চলচ্চিত্র দুনিয়া কিংবা সাহিত্যে একাধিকবার উঠে এসেছে জাতিস্মরের প্রসঙ্গ। এমনকি বাস্তবের দুনিয়ায় জাতিস্মর শান্তি দেবীর ঘটনা রীতিমতো চমকে দিয়েছিল স্বয়ং গান্ধীজিকেও। অবশ্য এই ঘটনা সে-সময়কার ব্রিটিশ শাসকরা স্রেফ ‘বুজরুগি’ বলেই অভিহিত করেছিলেন।

তবে মজার বিষয় হল, পাশ্চাত্যে এহেন ঘটনা বিরল হলেও, সম্পূর্ণ আনকোরা নয়। এমনকি বিশ শতকের শুরুতে ব্রিটেনেরই এক ঘটনা সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা বিশ্বে। ডরোথি এডি (Dorothy Eady) নামের এই কিশোরীর কিংবদন্তি রীতিমতো ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল নিউইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকাতেও। কারণ দু-একশো বছর নয়, ডরোথির স্মৃতির মধ্যে দিয়ে ভেসে উঠেছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের প্রাচীন ছবি। তাও সুদূর রহস্যময় দেশ মিশরের।

শুরু থেকেই বলা যাক এই ঘটনা। ১৯০৪ সালে ডরোথির জন্ম পূর্ব লন্ডনের এক আইরিশ মধ্যবিত্ত পরিবারে। আর পাঁচটা স্বাভাবিক শিশুর মতোই বেড়ে উঠছিল ডরোথি। কিন্তু বয়সে এক আশ্চর্য দুর্ঘটনাই বদলে দেয় গোটা পরিস্থিতিকে। আশ্চর্য না বলে ‘অলৌকিক’ বললেও ভুল হয় না এতটুকু। বছর তিনেক বয়স তখন ডরোথির। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়, আচমকা পা ফসকে পড়ে যান ডরোথি। বাবা-মায়ের নজরে যখন বিষয়টি আসে, ততক্ষণে নিথর হয়ে গেছে তাঁর দেহ। এমনকি চিকিৎসক এসে মৃত বলে ঘোষণা করেন তাঁকে। 

এর পর থেকেই ঘটতে থাকে একের পর এক আশ্চর্য ঘটনা। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই হঠাৎ প্রাণ ফিরে আসে ডরোথির দেহে। যেন সদ্য ঘুম ভেঙেছে তাঁর। জ্ঞান ফেরার পরেই খাটে বসে খেলতে শুরু করেন তিনি। সেইসঙ্গে একটি কথাই কেবল ঘুরে-ফিরে আসতে শুরু করে তাঁর মুখে, ‘বাড়ি যাব’। কিন্তু কোথায় এই ‘বাড়ি’? 

ডরোথির বর্ণনা ছিল অনেকটা ‘সোনার কেল্লা’-র মুকুলের মতোই। তাঁর বাড়ি নাকি বালির দেশে। পাথরের তৈরি বড়ো বড়ো স্থাপত্য রয়েছে সেখানে। বিষয়টিকে ততটাও আমল দেননি তাঁর বাবা-মা। তবে ডরোথির বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে পরিষ্কার হয় বিষয়টি। আদতে তিনি যে-দেশের কথা বলছেন, তা হল মিশর। তবে এখানেই শেষ নয়, খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি তাঁর তীব্র বিতৃষ্ণাও রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছিল ডরোথির বাবা-মাকে। এমনকি তাঁকে বহিষ্কার হতে হয় স্কুল থেকেও। তবে সমাধান? অনেকে উপদেশ দিয়েছিলেন, মিশরীয় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখানো হলে, এই মোহ থেকে বেরিয়ে আসবে তাঁদের সন্তান।

প্রায় বাধ্য হয়েই, একমাত্র সন্তানের মিশর-খিদে মেটাতে তাঁকে নিয়ে লন্ডন মিউজিয়ামে হাজির হন ডরোথির বাবা-মা। তাতে রচিত হয় সম্পূর্ণ উল্টোপুরাণ। মিউজিয়ামে ঢোকার পরেই, মানসিক ভারসাম্যহীনের মতো দৌড়াতে শুরু করেন ডরোথি। প্রাচীন মিশরীয় স্থাপত্য এবং মমির কফিনের পায়ে চুমু খেতে শুরু করেন তিনি। সঙ্গে অজানা এক ভাষায় বিড়বিড় করে যাওয়া আশ্চর্য সব মন্ত্র!

এই ঘটনায় ডরোথির বাবা-মায়ের থেকেও বেশি চমকে গিয়েছিলেন লন্ডন মিউজিয়ামের কিউরেটর। কারণ, বছর ছয়েকের শিশু যে ভাষায় কথা বলছে, তা আদতে প্রাচীন মিশরীয় ভাষা। কিন্তু কীভাবে তার আয়ত্তে এল এই ভাষা? 

না, এই রহস্যের সমাধান মেলেনি কোনোদিনই। আর ডরোথি? উত্তরোত্তর মিশরপ্রীতি বেড়েছে তাঁর। এমনকি মিশরের বিষয়ে তাঁর আশ্চর্য জ্ঞান নজর কেড়েছিল বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ওয়েলিস বাজেরও। তাঁর সৌজন্যেই এক মিশরীয় গবেষণা পত্রিকায় চাকরিও পেয়ে যান ডরোথি। হয়ে ওঠেন তৎকালীন সময়ের অন্যতম ইতিহাসবিদ। পরবর্তীতে স্থানান্তরিতও হন মিশরে। বিবাহ করেন এক মিশরীয় যুবককে। অবশ্য সেই বিবাহ টেকেনি বেশিদিন। ডরোথির অস্বাভাবিক আচরণই বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাঁর। 

মজার বিষয় হল, ডরোথির দাবি অনুযায়ী, তাঁর জন্ম ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সে-যুগে তাঁর নাম ছিল বেন্ত্রেশিত। কুমারী পুরোহিত হিসাবে তিনি নাকি কাজ করতেন এক প্রাচীন মন্দিরে। তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে, তাঁকে বিবাহ করেন মিশরীয় ফ্যারাও তথা রামেসিসের বাবা প্রথম সেটি। তবে সমাজ খুব একটা ভালো চোখে নেয়নি এই বিষয়টা। তাই বাধ্য হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বেন্ত্রেশিত। এই গোটা গল্পই অবশ্য ডরোথি-বর্ণিত। এমনকি পূর্বজন্মের স্মৃতি ফিরে পাওয়ার পর, ডরোথি নিজের পরিচয় দিতেন ‘ওম সেটি’ হিসাবে। যার আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘সেটির মা’। অর্থাৎ, মৃত্যুর সময় অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন বেন্ত্রেশিত। 

চল্লিশের দশকে এই গল্পের সত্যতা যাচাই করতে, সদ্য-আবিষ্কৃত সেটি-র মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। বেশ কিছু ছবি দেখিয়ে চিহ্নিত করতে বলা হয় প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলির অবস্থান। অবাক করার বিষয় হল, সে-সব স্থাপত্যের ছবি কোনোদিন না দেখা সত্ত্বেও পুঙ্খানুপুঙ্খ পথ বলে দিয়েছিলেন ডরোথি। এখানেই শেষ নয়, এহেন পরীক্ষায় একাধিকবার সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি। কিন্তু কীভাবে? তবে কি জাতিস্মরের তত্ত্ব সত্যি? ১৯৮১ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত মিশরই ছিল ডরোথির সবকিছু। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তারপর পেরিয়ে গেছে আরও ৪০টা বছর। তবে তাঁর পূর্বজন্মের স্মৃতি, জাতিস্মরবাদের এই রহস্যের কূলকিনারা করা সম্ভব হয়নি আজও…

Powered by Froala Editor

More From Author See More