গানের ‘গুঁতো’য় নিজের সমাধি-মন্দির বাঁচিয়েছিলেন এই ব্যক্তি!

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় প্রদেশের স্পিংফিল্ড শহরের ওক রিজ সমাধিক্ষেত্র (Oak Ridge Cemetery)। সারা বছরই সেখানে ভিড় লেগে থাকে দেশবিদেশের পর্যটকদের। কারণ এই সেমেট্রিতেই শায়িত আছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। তবে শুধু আব্রাহাম লিংকনই (Abraham Lincoln) নন, বিশ শতকের শেষলগ্নে ওক রিজ সেমেট্রিকে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দিয়েছিলেন অন্য এক ব্যক্তি। এমনকি তাঁর কর্মকাণ্ড নজর কেড়েছিল আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রের!

বিশ শতকের এই ‘তারকা’-র নাম রয় বার্তেল্লি (Roy Bertelli)। অবশ্য ‘মিস্টার অ্যাকর্ডিয়ান’ (Mr. Accordion) হিসাবেই নিজের পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন তিনি। হ্যাঁ, তিনি যে সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন, তা তো বোঝাই যাচ্ছে তাঁর নাম থেকে। কিন্তু কী এমন কাণ্ড বাঁধিয়েছিলেন এই মার্কিন ব্যক্তি? এই সমাধিক্ষেত্রের সঙ্গেই বা তাঁর যোগ কী? সরাসরি সেই গল্পেই যাওয়া যাক বরং। 

দেখতে গেলে ওক রিজ অতি ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা। আর অন্যতম রিয়েল এস্টেটে একমাত্র সমাধিক্ষেত্র ওক রিজ সেমেট্রিই। তবে এই সমাধিক্ষেত্রে জায়গা পাওয়ার জন্যই রীতিমতো ইঁদুরদৌড় চলে স্থানীয়দের মধ্যে। না, প্রিয়জনকে বাড়ি থেকে দূরে সমাধিস্থ করতে হবে বলে নয়। বরং, সকলেই চান পরজগতে আব্রাহাম লিংকনের প্রতিবেশী হতে। উচ্চ-চাহিদার জন্য তাই সমাধিস্থ হতে গেলে মোটা অঙ্কের টাকাও দিতে হয় সেমেট্রি কর্তৃপক্ষকে। 

রয় বার্তেল্লিরও শখ ছিল সেটাই। লিংকনের পাশে ‘জায়গা’ পেতে জীবিত থাকতে থাকতেই ৩০ হাজার মার্কিন ডলার খরচ করেছিলেন তিনি। শুধু নিজের জন্য জায়গা কেনাই নয়, ১৯৯৭ সালে সেখানেই বানিয়ে ফেলেছিলেন নিজের ভবিষ্যৎ মৌসলিয়াম। আর তা নিয়েই বাঁধে সমস্যা। 

এই মৌসলিয়াম তৈরির কিছুদিন পরেই সমাধিক্ষেত্রের কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে হাতে নোটিস পান বার্তেল্লি। তাঁকে নাকি ভেঙে ফেলতে হবে তাঁর ‘সমাধি মন্দির’। কেন? নাকি এই সমাধির জন্যই ঢাকা পড়ে যাচ্ছে লিংকনের সমাধিস্থল। প্রভাবিত হচ্ছে তার দৃষ্টিনান্দনিকতা। এমনকি দেশ-বিদেশের পর্যটকরাও নাকি অভিযোগ জানিয়েছেন বিষয়টি নিয়ে। 

তবে বার্তেল্লিও ছাড়ার পাত্র নন। প্রশাসনিক এই চাপের বিরুদ্ধে তিনিও চিঠি পাঠালেন স্টেট-জার্নাল রেজিস্টারের সম্পাদকের দপ্তরে। প্রকাশিতও হল সেই চিঠি। তাতে বার্তেল্লি স্পষ্ট উল্লেখও করলেন, তাঁর মৌসলিয়ামের নকশা জমা দেওয়ার পর, খোদ সেই নকশাকে ছাড়পত্র দিয়েছিল সেমেট্রি কর্তৃপক্ষ। দ্বিতীয় অভিযোগটি আরও গুরুতর। সেমেট্রি কর্তৃপক্ষ নাকি তাঁর সঙ্গীতচর্চার বিষয়টিকে অসম্মান করেছে! প্রশ্ন তুলেছে অ্যাকর্ডিয়ানের মাহাত্ম্য নিয়ে। তা নিয়ে রীতিমতো প্রশাসনকে শব্দবাণে জর্জরিতও করেন তিনি। আর কর্তৃপক্ষ যদি সত্যিই তাঁর সঙ্গীতসাধনা নিয়ে প্রশ্ন তুলে থাকে, তবে তা হবে না-ই বা কেন? কারণ, কিংবদন্তি সঙ্গীতবিদ লরেন্স ওয়েল্কের সঙ্গে অ্যাকর্ডিয়ান বাজিয়েছেন তিনি। ষাট-সত্তর দশকে কয়েকশো তরুণ-তরুণীদের প্রশিক্ষণও দিয়েছেন অ্যাকর্ডিয়ান-বাদনের। ফলে, এহেন অভিযোগ অভিমানে লাগাই তো স্বাভাবিক।

বার্তেল্লি এবং ওক রিজ সেমেট্রির এই সংঘাত তৎকালীন সময়ে রীতিমতো মুখরোচক বিষয় হয়ে উঠেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তবে সংবাদমাধ্যমে সাড়া ফেলে দেওয়ার পরও, প্রশাসন নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকলে, স্বয়ং যুদ্ধের ময়দানে নামেন বার্তেল্লি। নিজের মৌসলিয়ামের ওপরই টাঙিয়ে ফেলেন বেশ বড়ো আকারের একটি বোর্ড। তাতে লেখা ‘মিস্টার অ্যাকর্ডিয়ান’। প্রতিদিন নিজের অ্যাকর্ডিয়ান নিয়ে সেখানে হাজির হয়ে যেতেন তিনি। গান শোনাতেন উপস্থিত পর্যটকদের। লিংকনের সমাধির পাশাপাশি, এই বিচিত্র লাইভ কনসার্টের সামনেও রীতিমতো ভিড় জমে যেত। 

২০০৩ সাল পর্যন্ত কেটেছে এভাবেই। তারপর মারা যান মিস্টার অ্যাকর্ডিয়ান। শেষ পর্যন্ত তাঁর এই বিপুল জনপ্রিয়তাই বাঁচিয়ে দেয় তাঁর মৌসলিয়ামটিকে। অবশ্য বিতর্ক রয়েই গেছে। সেই সমাধিক্ষেত্রে আদৌ বার্তেল্লি সমাধিস্থ আছেন কিনা, তা নিয়ে আজও কাটেনি ধাঁধাঁ। একদল মানুষের অভিমত, বার্তেল্লির দেহ দাহ করার পর, তাঁর ভস্ম সমাধিস্থ হয়েছিল ওক রিজের এই মৌসলিয়ামের। অনেকের মতে এই মৌসলিয়ামে যে ছাই রয়েছে, তা আদতে তাঁর একটি প্রিয় অ্যাকর্ডিয়ানের। অন্যদিকে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল দূরবর্তী এক কবরস্থানে। এসবই ছিল না ওক রিজ সেমেট্রির চক্রান্ত।

একমাত্র এই বিতর্কে ইতি টানতে পারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি নথিই। যেখানে প্রতিনিয়ত লিপিবদ্ধ করা হয় কোন সমাধিক্ষেত্রে কাকে সমাধিস্থ করা হচ্ছে। তবে মজার বিষয় হল, সেই ওয়েবসাইটে ‘রয় বার্তেল্লি’ বা ‘মিস্টার অ্যাকর্ডিয়ান’ নামে কোনো ব্যক্তিরই নথিই হাজির নেই! সবমিলিয়ে বলতে গেলে লিংকনের পরলৌকিক প্রতিবেশীরাও কম রহস্যময় নয় বৈকি…

Powered by Froala Editor