চলতি বছরে, যেসব বিশিষ্ট বাঙালিকে হারালাম আমরা

বছরশেষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ২০১৯। কত পাওয়া, না-পাওয়া পেরিয়ে একটা নতুন সময়ের মধ্যে ঢুকছি আমরা। বাঙালি যেমন পেয়েছে, তেমনই হারিয়েছে অনেককে। এ-বছর যাঁরা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে, তাঁদের মধ্যে ১০ বিশিষ্ট বাঙালিকে আরও একবার স্মরণ করে নেওয়া আমাদের—

পিনাকী ঠাকুর

বছরের একদম শুরুতেই বাংলা সাহিত্যজগত পেল একটি দুঃসংবাদ। সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৩ জানুয়ারি প্রয়াত হয়েছেন এই সময়ের বিশিষ্ট কবি পিনাকী ঠাকুর। হঠাৎ করেই যেন ছায়া হয়ে গেলেন তিনি। কিন্তু তেমনটা তো কথা ছিল না! ‘একদিন অশরীরী’, ‘চুম্বনের ক্ষত’, ‘হ্যাঁ রে শ্বাশ্বত’— একের পর এক উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ উপহার দিয়েছেন আমাদের। আজ আর বইমেলা প্রাঙ্গনে দেখা যাবে না চশমা পরা হাসিখুশি মুখটিকে।

দিব্যেন্দু পালিত

৩ জানুয়ারি, পিনাকী ঠাকুরের সঙ্গে একই দিনে প্রয়াত হন বিশিষ্ট সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিত। তবে সাহিত্যিকের পাশাপাশি তাঁর পরিচয় একজন সাংবাদিক, সম্পাদক, অ্যাড কর্মী হিসেবেও। মিতভাষী এই মানুষটি জীবদ্দশায় পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। দিয়ে গিয়েছেন একের পর এক লেখা। সবকিছুর ইতি এই বছরে।

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রায় তৈরি হয়েই গিয়েছিল তাঁর সাম্প্রতিক উপন্যাস। বই আকারে বেরোবে কথা ছিল। প্রচ্ছদও তৈরি। কিন্তু, বাধ সাধলেন মানুষটি। নীলকণ্ঠ পাখি খোঁজার ডাক যে এসে গেছে ততক্ষণে! এই বছর ১৯ জানুয়ারিতে চলে গেলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। বছরখানেক আগে স্ত্রীও মারা গিয়েছিলেন। সেই ধাক্কা সামলাতে পারেননি আর। ৮৫ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি।

আল মাহমুদ

বাংলাদেশ তো বটেই, বাংলা ভাষার অন্যতম অগ্রজ কবি ছিলেন আল মাহমুদ। চলে গেলেন ১৫ ফেব্রুয়ারি। ‘সোনালি কাবিন’-এর কবি দীর্ঘদিন ভুগছিলেন বার্ধক্যজনিত অসুখে। এছাড়াও থাবা বসিয়েছিল নিউমোনিয়া। জীবৎকালে পেয়েছেন বহু সম্মান। তাছাড়াও পেয়েছেন দুই বাংলার অগুনতি অনুরাগী। সাংবাদিকতার কাজও করেছেন দীর্ঘসময় ধরে। তবে এই কয়েক শব্দে কি ধরা যায় আল মাহমুদ’কে?

চিন্ময় রায়

বাংলা সিনেমার জগতে টেনিদাকে বিখ্যাত করেছেন ইনি। সমস্ত কমিক চরিত্রে তাঁর উপস্থিতি ছিল জোরদার। সেই চিন্ময় রায় চলে গেলেন এই বছর। ‘চারমূর্তি’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘গল্প হলেও সত্যি’, ‘মৌচাক’— এই সব ছবি যাঁরা দেখেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই চিনে নেবেন অভিনেতা চিন্ময় রায়ের জাত। শুধু পর্দায় নয়, থিয়েটার মঞ্চেও দাপিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি। কিন্তু শরীর আর দিচ্ছিল না। একদিন বাড়ির নীচে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় তাঁকে। চোট পেয়েছিলেন, সেখান থেকেই রোগ বেড়ে যাচ্ছিল। সমস্ত কিছুর অবসান হল ১৭ মার্চে।

অমর পাল

“দেখো ভালজনে রইল ভাঙা ঘরে/ মন্দ যে সে সিংহাসনে চড়ে”— যার গলা দিয়ে এই অমোঘ কথাটি বেরিয়েছিল, তিনি চলে গেলেন এই বছর। অমর পাল। তবে এই একটা গানই নয়, বাংলা লোকসঙ্গীতের জগতে একটি বিশিষ্ট স্থান নিয়ে আছেন তিনি। আকাশবাণীতে লোকসঙ্গীত শিল্পী হিসেবেও কাজ করেছেন। ২০ এপ্রিলের সকালে গানের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কাটাচ্ছিলেন তিনি। তারপরেই, দুঃসংবাদ। গাইতে গাইতেই চলে গেলেন নেপথ্যের চরণ দাস।

স্বরূপ দত্ত

সাতের দশকের বাংলা সিনেমা। দর্শক পেল এক সুদর্শন অভিনেতাকে। ঠোঁটের নীচে তিল, প্রায় সিগনেচার ছিল যাঁর। সেই স্বরূপ দত্ত চলে গেলেন ১৭ জুলাই, ৭৮ বছর বয়সে। উৎপল দত্তের স্নেহধন্য এই অভিনেতা খ্যাতি পেয়েছিলেন তপন সিনহার ‘আপনজন’ সিনেমা থেকে। তারপর অনেক উল্লেখযোগ্য সিনেমায় অসাধারণ অভিনয় করলেও, বড় মুখের পেছনের মানুষটি হয়েই থেকে গেছেন তিনি। তবে সিরিয়াস দর্শকরা কি তাঁকে বাদ দিয়েছেন?

নবনীতা দেবসেন

বছরের শেষের দিকে শূন্য হল ‘ভাল-বাসা’। দীর্ঘ বহু বছরের ক্যানসার যুদ্ধের পর হার মানলেন সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন। অথচ হার মানা তাঁর স্বভাবে ছিল না কখনও। শুধু রাধারানী দেবী-নরেন্দ্র দেবের মেয়ে হিসেবে, বা অমর্ত্য সেনের স্ত্রী হিসেবে তাঁর পরিচয় নয়। তার থেকেও বেশি কিছু ছিলেন তিনি। ৭ নভেম্বর, ক্যানসার সচেতনতা দিবসের দিন অবশেষে সেই হাসিখুশি মুখটি স্তব্ধ হল। শূন্য হল বাংলা সাহিত্যের আরও একটি আঙিনা।

রাম রে

বাংলা তো বটেই, ভারতের বিজ্ঞাপন জগতে একসময় বদল এনে দিয়েছিলেন এই মানুষটি। রাম রে। নামটির সঙ্গে গোটা বিশ্ব পরিচিত। একসময় ‘জেডব্লুটি’-তে কাজ করেছেন দীর্ঘ কয়েক দশক। তৈরি করেছেন নিজের সংস্থা, ক্ল্যারিয়ন বেটস। ফ্রুটি, কুকমি, বোরোলিন, মাদার ডেয়ারি, কোয়ালিটি ইত্যাদি কোম্পানির কালজয়ী বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিলেন তিনি; যা আজও সমান জনপ্রিয়। পেয়েছেন হল অফ ফেম সম্মান। ১২ নভেম্বর থেমে গেল সেই যাত্রা।

গীতা চট্টোপাধ্যায়

১৪ ডিসেম্বর, বাংলা দেখল আরও এক কবির নিঃশব্দ মৃত্যু। গীতা চট্টোপাধ্যায়। প্রতিবাদ, রাজনীতি, আধ্যাত্মিকতা— সবকিছু নিয়ে তাঁর কবিতার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসেন পাঠক। প্রতিষ্ঠান তাঁকে মান্যতা দেয়নি। অবশ্য যিনি লিখেছিলেন ‘তিন লাথি মেরে আমি ঢেকে দেব তাবৎ আসমান’, তিনি এসবের পরোয়া করতেন না কখনই। গীতা চট্টোপাধ্যায় চলে গেলেন, দিয়ে গেলেন বাংলা কবিতায় এক ব্যতিক্রমী ধারা।