প্রয়াত ‘দ্য ওয়েলারস’-এর শেষ সদস্য বানি ওয়েলার, শেষ হল রেজি সঙ্গীতের একটি অধ্যায়

ষাটের দশকের শুরুর দিকের কথা। কিংস্টোন শহর জুড়ে তখন শুধুই যেন হাহাকার। দারিদ্রে ঝলসে যাচ্ছে খোদ জামাইকার রাজধানী। ক্ষুধার্ত শিশু আর তার ক্রন্দনরত মায়ের যন্ত্রণাটাকেই গানের ভাষায় ধরেছিলেন তিনি। তখনও কুড়ির গণ্ডি পেরোননি তিনি। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু ও ভাই বব মার্লে। জামাইকা-জুড়ে খেলে যাওয়া রেজি সঙ্গীত বিপ্লবের অন্যতম কাণ্ডারি তিনি। বানি ওয়েলার। গত মঙ্গলবার পৃথিবীকে বিদায় জানালেন এই বিখ্যাত কিংবদন্তি রেজি সঙ্গীতশিল্পী।

সম্প্রতি তাঁর মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করেন তাঁর ম্যানেজার ম্যাক্সাইন স্টো। জামাইকার সংস্কৃতি মন্ত্রী অলিভিয়া গ্রেঞ্জও নিশ্চিত করেছেন তাঁর মৃত্যুর খবর। তবে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যায়নি এখনও। ২০২০ সালের জুলাই মাসে ম্যাসিভ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন বানি ওয়েলার। তারপর থেকে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বানি ওয়েলার। বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। ১৯৮১ সালে বব মার্লের মৃত্যু ও ১৯৮৭ সালে পিটার তোশের হত্যার পরকিংবদন্তি রেজি ব্যান্ড ‘দ্য ওয়েলারস’-এর শেষ সদস্য হিসাবে একমাত্র জীবিত ছিলেন তিনিই।

১৯৪৭ সালের ১০ এপ্রিল বানি ওয়েলারের জন্ম জামাইকার নাইন মাইলস গ্রামে। তবে বানি ওয়েলার হয়ে উঠতে তখনও ঢের বাকি তাঁর। পরিচয়পত্রে নাম ছিল নেভিল ও’রিলে লিভিংস্টোন। বাবা থাডিয়াসের ছিল ছোট্ট মুদির দোকান। তাঁর কাছেই বড়ো হয়ে ওঠা বানি ওয়েলারের। জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিলেন মা। বব মার্লির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় নাইন মাইলস গ্রামেরই স্টেফনি প্রাথমিক স্কুলে। একদম ছোট্ট বয়স থেকেই সঙ্গীতপ্রেম আরও গাঢ় করে তুলেছিল দুই বন্ধুর বন্ধুত্বকে।

১৯৫৫ সালে বব মার্লের বাবার মৃত্যুর পর তাঁর মা সিডেলা দ্বিতীয় বিবাহ করে বানি ওয়াকের বাবাকে। দুই বন্ধুর জীবন যেন বেঁধে যায় আত্মীয়তার সূত্রে। বড়ো হয়ে ওঠাও একই বাড়িতে। আরেকটু বয়স বাড়তে দুই ভাইয়ে ঠিকানা বদলে যায় কিংস্টোনের ট্রেঞ্চটাউনে। চরম দারিদ্র এবং সাম্প্রদায়িক সিংহা যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, নতুন শহরে এসে পরিচিত হয়েছিলেন দুই কিংবদন্তিই। আর গানের কথা হয়ে ফুটে উঠেছিল সেই অভিব্যক্তিগুলোই।

আরও পড়ুন
গানের সূত্রে ঢুকে পড়বে পশ্চিমি পুঁজিবাদ; কিউবায় লেননকে নিষিদ্ধ করলেন ফিদেল কাস্ত্রো

নব্বইয়ের দশকে এক সাক্ষাৎকারে বানি ওয়েলার জানিয়েছিলেন, সে-সময় অর্থাভাব এমনই ছিল যে গিটার কেনার সামর্থ্যও ছিল না তাঁদের। দুই ভাই মিলে বাঁশের সঙ্গে বড়ো সার্ডিনের টিন জুড়ে বৈদ্যুতিক তার দিয়ে বাদ্যযন্ত্র বানিয়েছিলেন তাঁরা। কিংস্টোনের টেঞ্চটাউনেই পিটার তোশের সঙ্গে পরিচয় হয় মার্লেদের। তারপর গড়ে ওঠে ভোকাল ব্যান্ড ‘দ্য ওয়েলারস’।

সৃজনশীলতা কিংবা সঙ্গীতের দক্ষতায় এতটুকু কমতি ছিল না তিন খুদে তারকারই। কাজেই সঙ্গীতশিল্পী জো হিগসের চোখে পড়তে খুব বেশি দেরি হয়নি তাঁদের। রেজির গডফাদার-খ্যাত হিগসের তত্ত্বাবধানেই যেন আরও ক্ষুরধার হয়ে উঠেছিল ‘দ্য ওয়েলারস’। ধীরে ধীরে এই ব্যান্ডে যুক্ত হয় ব্রেথওয়েট জুনিয়ার, বেয়ারলি কেলসো, চেরি গ্রিন প্রমুখ তারকারা।

আরও পড়ুন
বিক্রি হয়ে গেল বব ডিলানের লেখা সমস্ত গানের স্বত্ব

১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরে কক্সসন ডডের স্টুডিয়োয় রেকর্ড হয় ‘দ্য ওয়েলারস’-এর প্রথম গান। বব মার্লের লেখা সেই গানে ছিল কিংস্টোনের অরাজকতা ভেঙে শান্তির আহ্বান। সুরের থেকেও সে-গানের কথারা যেন আন্দোলিত করে তুলেছিল গোটা কিংস্টোন শহরকে। গানটি তাৎক্ষনিক ‘হিট’ হয়ে যায় জামাইকায়। জনপ্রিয়তার নিরিখে টানা দু’বছরেরও বেশি সময় শীর্ষস্থান ধরে রেখেছিল গানটি।

বছর দেড়েক পর ১৯৬৫ সালে জামাইকাকে আরও একবার নাড়িয়ে দেয় ‘দ্য ওয়েলারস’। প্রকাশ পায় প্রথম অ্যালবাম ‘দ্য ওয়েলিং ওয়েলারস’। বানি ওয়েলারের লেখা ‘রুড বয়’ গানটি সেসময় হয়ে উঠেছিল ‘ইয়ুথ অ্যান্থেম’।

আরও পড়ুন
বিচ্ছেদের ৪৪ বছর পরে ক্ষমাপ্রার্থনা; বব ডিলান ও এক সঙ্গীতময় সম্পর্কের আখ্যান

তবে যে সময়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠা শুরু করেছে ‘দ্য ওয়েলারস’, সেই সময়েই দেশ ছাড়েন বব মার্লে। বিবাহের পর চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। অন্যদিকে মারিজুয়ানা চক্রে গ্রেপ্তার হন বানি ওয়েলারও। সেটা ১৯৬৬-৬৭ সালের কথা। দীর্ঘ এক বছর জেল খাটতে হয়েছিল বানি ওয়েলারকে। তবে থেমে থাকেনি গান বানানো। ওয়েলারসের দ্বিতীয় অ্যালবাম প্রকাশের আগেই ২৮টি একক গান প্রকাশ করেছিলেন বানি, পিটার তোশ ও বব মার্লে। 

বানি ওয়েলার চিরকালই চাইতেন রেজির সঙ্গে মিশে যাক রক সঙ্গীত। তবে দেশের গণ্ডি ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার পরিপন্থী ছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে বানির সেই স্বপ্নপূরণ করেন বব মার্লে। ব্রিটেনে গিয়ে রেকর্ড করেন ‘স্টিয়ার ইট আপ’, ‘ক্যাচ আ ফায়ার’-এর মতো গান। যা আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছিল ‘দ্য ওয়েলারস’-কে। 

তবে সেই অ্যালবাম আন্তর্জাতিক বাজারে খুব কিছু বিক্রি হয়েছিল ধরে নেওয়া ভুল হবে। তবে ‘রোলিং স্টোন’ সঙ্গীতপত্রিকার সাম্প্রতিক তালিকা অনুযায়ী সারা বিশ্বের সর্বকালীন ৫০০টি অ্যালবামের মধ্যে ১৪০ নম্বরে রয়েছে সেই অ্যালবাম। যে রকের থেকেও বেশি জনপ্রিয় ক্লাসিক হিসাবে।

১৯৭৩ সালে বব মার্লে দেশে ফিরে আবার সংগঠিত করেন ‘দ্য ওয়েলারস’-কে। শুরু হয় দেশের বিভিন্নপ্রান্তে সঙ্গীতসফর। আর সেই ব্যস্ত সফরসূচির কারণেই ওই একই বছর ব্যান্ড ছাড়েন বানি ওয়েলার। তবে বব মার্লের সঙ্গে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ ছিল তাঁর। পরবর্তীকালে একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন পরিবারের থেকে দূরে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না কোনোভাবেই। 

সব মিলিয়ে তিনবার সেরা রেজি অ্যালবামের জন্য গ্র্যামি পুরস্কার পেয়েছেন বানি ওয়েলার। ২০১৭ সালে পেয়েছেন জামাইকার সর্বোচ্চ সম্মান ‘অর্ডার অফ মেরিট’। পেয়েছেন সম্মানজনক পিনাকেল অ্যাওয়ার্ডও। 

তবে বানি ওয়েলারের বিশ্বাস ছিল, খ্যাতি সৃজনশীলতার সবথেকে বড়ো শত্রু। একাধিকবার তিনি উল্লেখ করেছেন ‘তারকা হওয়ার থেকেও বেশি প্রয়োজন একজন ভালো লেখক, সঙ্গীয়শিল্পী, প্রযোজক হওয়া’। আর সে জন্যই বোধ হয় ‘দ্য ওয়ালারস’ ছাড়ার পর বাকি জীবন একান্তেই কাটিয়েছেন তিনি। একের পর এক হিট একক গানের পরেও চিরকাল থেকে গেছেন অন্তরালে। বড়ো অঙ্কের টাকার সুযোগ পাওয়ার পরেও দেশের বাইরে পা দেননি কখনো। সেই জায়গাতেই তিনি বাকিদের থেকে আলাদা, অনন্য…

Powered by Froala Editor