অন্তিম জন্মদিন কাটল শান্তিনিকেতনেই, কাছের মানুষেরা ঘিরে রইলেন কবিকে

রবীন্দ্রনাথ প্রথম নিজের জন্মদিন সম্বন্ধে প্রথম গানটি লিখেছিলেন ১৩০৬ বঙ্গাব্দে, সে গান কবিতা আকারে সংকলিত হয় ‘কল্পনা’ কাব্যগ্রন্থে। “ভয় হতে তব অভয়মাঝে নূতন জনম দাও হে”- এই ছিল সে গানের ধ্রুবপদ।

মর্ত্যজীবনের শেষ জন্মদিনের জন্য কবি যে গান রচনা করলেন, তাতেও ধ্বনিত হল সকল অন্ধকার ভেদ করে এক জ্যোতির্ময় উদ্ভাসনের বাণী। ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের ‘পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতাটির কয়েকটি ছত্র নিয়ে, একটু অদলবদল ঘটিয়ে ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২৩ বৈশাখ (৬ মে, ১৯৪১) “হে নূতন” গানটি রচনা করলেন কবি। ভৈরবী রাগ ও কাহারবা তালের আশ্রয়ে এই গানে সুরযোজনাও তাঁরই কীর্তি। স্বরলিপিটি করেছিলেন কবির স্নেহধন্য শান্তিদেব ঘোষ। কবির জন্মদিন উপলক্ষে লেখা সকল গানের চেয়ে, এই অন্তিম গানটিই আজ সবচেয়ে বেশি পরিচিত, সর্বাধিক শ্রুত। আজও, জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রভবনে কবির জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে প্রভাতী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনে সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হয় এই গান:

“হে নূতন,
দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।।
তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন
সূর্যের মতন।
রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন
ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,
ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।
উদয়দিগন্তে শঙ্খ বাজে, মোর চিত্তমাঝে
চিরনূতনেরে দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ।।”

১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ। শান্তিনিকেতনে কবির জন্মদিন পালিত হল অনাড়ম্বরে। কয়েকদিন আগে, নতুন বছরের পত্রপত্রিকায় রবীন্দ্রজয়ন্তী সম্বন্ধে আলোচনার কথা শুনে কবি রাণী চন্দকে বলেছিলেন, “সাহিত্যজীবনে খ্যাতি বড়ো ক্ষণস্থায়ী… দুদিনেই সব উবে যায়। সংসারের বড়ো জিনিস হচ্ছে প্রীতি, খ্যাতি নয়। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি যখন তোমাদের কাছ থেকে প্রীতি, ভালোবাসা পাই। …আমি এই ভালোবাসাই পেয়েছি জীবনে অনেক- কী দেশে কী বিদেশে। পেয়েছি নিজের লোকের কাছ থেকে, তার ঢের বেশি পেয়েছি অনাত্মীয়ের কাছ থেকে।” (আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ, রাণী চন্দ)। কোনও আড়ম্বর বা চাকচিক্য নয়, শান্তিনিকেতনের নিভৃত পরিবেশে, একান্ত আপনজনেদের ভালোবাসার অর্ঘ্য পেয়ে সার্থক হল কবির অন্তিম জন্মদিন। সেদিন সন্ধ্যায় আশ্রমের ছাত্রীরা কবিকৃত ‘বশীকরণ’ প্রহসনটি অভিনয় করেছিল, কবি অভিনয়ের একেবারে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন। এই তাঁর অন্তিম অভিনয়-দর্শন।

এই জন্মদিন উপলক্ষে কবি অন্নদাশঙ্কর রায়কে একটি কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন। ‘উদয়ন’ বাসগৃহে লেখা সেই কবিতা সেই বছরের শ্রাবণ সংখ্যায় ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ছাপা হয়, পরে ‘শেষ লেখা’ কাব্যগ্রন্থে ১০ সংখ্যক কবিতারূপে অন্তর্ভুক্ত হয়। সেই কবিতায় কবি বলেন:
“আমার এ জন্মদিন-মাঝে আমি হারা,
আমি চাহি বন্ধুজন যারা
তাহাদের হাতের পরশে
মর্ত্যের অন্তিম প্রীতিরসে
নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ,
নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ।
শূন্য ঝুলি আজিকে আমার;
দিয়েছি উজাড় করি
যাহা কিছু আছিল দিবার,
প্রতিদানে যদি কিছু পাই-
কিছু স্নেহ, কিছু ক্ষমা-
তবে তাহা সঙ্গে নিয়ে যাই
পারের খেয়ায় যাব যবে
ভাষাহীন শেষের উৎসবে।”

কবি বলে গেলেন- অর্থ নয়, কীর্তি কিংবা স্বচ্ছলতা নয় - মানুষের এই ভালোবাসাই আমাদের প্রত্যেকের জীবনের অন্তিম পাথেয়।

চিত্র ঋণ - পিন্টারেস্ট