এশিয়ায় প্রথম প্লেনের টায়ার তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে ডানলপের ইতিহাস

মূল কলকাতার সীমানা ছাড়িয়ে উত্তর শহরতলির দিকে ঢুকলেই আপনাকে স্বাগত জানাবে ডানলপ মোড়। বাঁদিকে দক্ষিণেশ্বর, গঙ্গা পেরোলেই হাওড়া; উত্তরে ব্যারাকপুর আর দক্ষিণে কলকাতা— বলা ভালো উত্তরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা এটি। রাতদিন গাড়ির যাতায়াত, ব্যস্ত মানুষ, কোলাহল; আর তার মাঝেই লুকিয়ে আছে একটি ইতিহাস। লুকিয়ে আছে জায়গাটির নামেই। একটি রাবার কোম্পানি, বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা এবং একটি মানুষের ‘চাকা আবিষ্কার’-এর কাহিনি…

সালটা ১৮৮৭। স্কটল্যান্ডে নিজের বাড়ির সামনে ট্রাইসাইকেল চালাচ্ছে একটি বাচ্চা ছেলে। একটু দূরেই বসে আছেন বাবা। পেশায় পশুদের চিকিৎসক। হঠাৎই খটকা লাগল তাঁর। ছেলে যে ট্রাইসাইকেলটি চালাচ্ছে, সেটির গতিবেগ বেশ কম। যেন টেনে টেনে, কষ্ট করে নিয়ে যেতে হচ্ছে। আচ্ছা, এই অসুবিধা কেন? একে দূর করার উপায় কী? বাবা উঠে এলেন, মন দিয়ে কিছুক্ষণ দেখলেন সাইকেলটিকে। একটা সলিড রাবারকে চাকা বানিয়ে লাগানো হয়েছে সেখানে। খুব একটা ভালো কাজ যে হচ্ছে না, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। 

লোকটি ঠিক করলেন, ছেলের এই অসুবিধার সমাধান করবেন। কী করলেন তিনি? চাকার গোলাকার, ধাতব অংশের বাইরে পাতলা এবং ভালো মানের রাবারের আচ্ছাদন দিলেন। ভালো করে আঠা দিয়ে আটকে দিলেন; এবং ফুটবল পাম্প দিয়ে রাবারের আচ্ছাদনের ভেতর হাওয়া ভরে দিলেন। ‘এবার চালিয়ে দেখো তো!’ তাজ্জব ব্যাপার! ট্রাইসাইকেলের গতিও আগের থেকে যেমন বেড়েছে, তেমনই চালাতেও সুবিধা হচ্ছে। বাচ্চা ছেলেটির বাবা, যিনি ছিলেন পেশায় পশু চিকিৎসক, তাঁর হাত ধরেই পৃথিবীর ইতিহাসটা গেল বদলে। এ যেন নব প্রযুক্তির ‘চাকা আবিষ্কার’। ভদ্রলোকের নাম জন বয়েড ডানলপ। 

১৮৮৭ সালের সেইদিন থেকেই শুরু হল রাবারের টায়ারের পথ চলা। আজ সভ্যতা আধুনিক হয়েছে, প্রযুক্তি আমাদের সকল কল্পনা ছাড়িয়ে ডানা মেলছে; তার মধ্যেও একই থেকে গেছে জন ডানলপের এই আবিষ্কার। এক বছর পর বাইসাইকেল নিয়েও একই পরীক্ষা করলেন তিনি; এবং এখানেও সফল। নিজের দেশ স্কটল্যান্ডে তো বটেই, গোটা পৃথিবীতেই হইচই পড়ে গেল। পেটেন্ট নিতে দেরি করলেন না ডানলপ। এবং তারপরই ১৮৯০ সালে তৈরি করলেন নিজের প্রতিষ্ঠান— ‘ডানলপ নিউম্যাটিক টায়ার কোং লিমিটেড’। ডাবলিনে শুরু হয়েছিল প্রথম টায়ার তৈরির কারখানা। এরপর জার্মানি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা— ডানলপ আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। ১৯১৩ সালে জাপানের কোবে শহরেও পৌঁছে যায় এই প্রতিষ্ঠান। আর আজ? সাইকেলের টায়ার থেকে স্পোর্টস টায়ার— সব জায়গায় উজ্জ্বল উপস্থিতি ডানলপের। ‘ডি’ লেখা সেই লোগোটা কিংবদন্তির পর্যায় পৌঁছে গেল। ডানলপ একটি ব্র্যান্ডের নাম, একটি ইতিহাসের নাম। পৃথিবী বদলে দেওয়ার ইতিহাস… 

আরও পড়ুন
এশিয়ার বৃহত্তম যৌনপল্লীর নাম ‘সোনাগাছি’ হল কীভাবে?

একটা সময় সেই ঢেউ এসে পড়ল ভারতেও। তখনও এই দেশে ব্রিটিশদের রাজত্ব। হুগলি নদীর দুই তীরে তৈরি হয়েছে একের পর এক শিল্পাঞ্চল। সেখানেই নতুন অতিথি হিসেবে হাজির হল ডানলপ টায়ারস। ১৯৩৬ সাল। ব্যান্ডেলের কাছেই সাহাগঞ্জে তৈরি হল ভারতের প্রথম টায়ার কারখানা। সে এক বিরাট ইতিহাস। রাতারাতি সাহাগঞ্জের ছবিটাই গেল বদলে। বদলে গেল এখানে কাজ করা মানুষদের জীবন। লোকমুখে তাঁদের পরিচয় ‘ডানলপ বাবু’ নামে। সাইকেলের টায়ার দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও, ছবিটা বদলে গেল অচিরেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। গোটা বিশ্বে জ্বলেছে আগুন। সেই সময়ই ডানলপ কারখানায় শুরু হল এরোপ্লেন ও ফাইটার প্লেনের টায়ার তৈরির কাজ। ভারত তো বটেই, এশিয়াতেও প্রথম এমন উদ্যোগ নেওয়া হল। আর তার সাক্ষী থাকল বাংলা, সাহাগঞ্জ। নতুন নতুন কারখানা, আস্ত শিল্পাঞ্চল, কোয়ার্টার— সব মিলিয়ে এক এলাহি আয়োজন… 

সাহাগঞ্জের ঢেউ এসে পড়ল নদীর এপারেও। তখন বরাহনগরের ওপর দিয়ে হুগলির দিকে চলে গেছে রেলব্রিজ। এই অঞ্চলেও সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কারখানা। এই বিশেষ জায়গাটির গুরুত্ব তখন থেকেই অপরিসীম। এই একটি জায়গা থেকে কলকাতা, ব্যারাকপুর, হুগলি, দমদম— সব দিকেই যাওয়া যায়। যদি বিজ্ঞাপন করা যায়, তাহলে অনেক মানুষের নজরে আসতে পারে। ব্যস, এই চিন্তা থেকেই শুরু হল কাজ। রেলব্রিজের গায়ে পড়ল বিজ্ঞাপন। পরবর্তীকালে আরও দুটি ব্রিজ তৈরি হলে তার গায়েও পড়ল ডানলপের বিখ্যাত সেই লোগোর ছাপ। এবার বিজ্ঞাপনে নয়, সরাসরি রং করে। লোকমুখে অঞ্চলটির নামও হয়ে গেল ডানলপ মোড়। আজও যে নাম অমলিন… 

আরও পড়ুন
ত্রিকোণ প্রেম থেকে খুন; এশিয়ার বুকে প্রথম ডিএনএ পরীক্ষার প্রথম প্রয়োগ কলকাতাতেই

সময় এগিয়ে যায়। কত জিনিস ভাঙে, আবার কত জিনিস গড়ে। বর্তমানে শিল্পের পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়। রমরমা ডানলপ কোম্পানিও বাংলার বুকে টিকে আছে কোনোরকমে। সেই জাঁকজমক আর নেই। যে ব্রিজের গায়ে ডানলপের লোগো বসেছিল, ওইরকম রং করা হয়েছিল; সেটিও এই কয়েকবছর আগে ভেঙে ফেলা হয়েছে। ওখান দিয়ে হাঁটলে এখনও হয়তো টুকরো টুকরো ইট চোখে পড়বে। অথচ কয়েক বছর আগেও লোকে ব্রিজের গায়ে দেখে গেছে সেই চিহ্ন। কিন্তু ইতিহাস? তাকে কি অস্বীকার করা যাবে? সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ের একটা কোম্পানির নামে কলকাতার উত্তর শহরতলির একটি অঞ্চল সজ্জিত হয়েছে। সেটা তো মোছেনি এখনও! আসলে ডানলপ কোনো মানচিত্রের গণ্ডিতে আটকে নেই। চাকার মতো গড়িয়ে চলেছে সে। ছড়িয়ে পড়ছে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কলকাতায়। আর তার হাত ধরেই টিকে আছে বাংলার দুটি অঞ্চল— সাহাগঞ্জ এবং ডানলপ মোড়… 

তথ্যসূত্র –
১) ‘কলকাতার ‘শহিদ ভগৎ সিংহ চক’। চেনেন নাকি!’, এবেলা
২) ‘History: Where it all began’, Dunlop official website
৩) Wikipedia 

আরও পড়ুন
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে সমপ্রেমকে আইনি স্বীকৃতি থাইল্যান্ডের

Powered by Froala Editor