নিরঞ্জনের আগে নদীবক্ষে প্রতিমা-ভ্রমণ, প্রাচীন রীতি আজও বহাল পানিহাটিতে

“ছোটবেলায় বাপ-ঠাকুর্দার কাছে গল্প শুনেছি। ত্রাণনাথ ঠাকুরের প্রতিমা ঠিক এইভাবে পানিহাটির ঘাট থেকে দক্ষিণে দক্ষিণেশ্বর উত্তরে ব্যারাকপুরের ঘাট পর্যন্ত নৌকোয় ঘুরিয়ে আনা হত। তারপর আবার এই ঘাটে এসে হত প্রতিমা নিরঞ্জন।” গঙ্গাবক্ষে ভাসমান নৌকোয় বসে বলছিলেন কেশব মুখোপাধ্যায়। তিনি যদিও কোনোদিন সেই প্রথা দেখেননি। কিন্তু গল্প শুনে শুনেই যেন অনুভব করতেন সেইসব দিনগুলিকে। তারপর ১৯৯৪ সালে নিজেই শুরু করে দিলেন পুজো। আর প্রতিমার কাঠামো থেকে নিরঞ্জনের রীতি, সবকিছুতেই মাথায় রেখেছেন সেই ছেলেবেলার শোনা গল্পের দিনগুলিকে।

হুগলি নদীর তীরে ঐতিহাসিক শহর পানিহাটি। একসময় সাহেবরা যার নাম দিয়েছিলেন পেনেটি। উনিশ শতকে বাগবাজারের এক গঙ্গোপাধ্যায় স্বপ্নাদেশ পান, পেনেটির নদীবক্ষে নিমজ্জিত আছেন মা ভবানী। মজুর নিয়ে এসে ঘাটের মাটির খুঁড়তেই সন্ধান পাওয়া যায় সেই মূর্তির। শোনা যায়, দেবীর আশীর্বাদে নাকি পরিবারে সুখ সমৃদ্ধিও ফিরে এসেছিল। বাগবাজারে ফিরে যাওয়ার আগে নসীরাম বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক পুরোহিতের হাতে দিয়ে যান নিত্যপূজার দায়িত্ব। নসীরামের অকাল মৃত্যু হলে তার দায়িত্ব নেন ৮ বছরের পুত্র ত্রাণনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

পাণিহাটি ত্রাণনাথ ঘাটের মা ভবানী মন্দির

 

আজ পানিহাটি শহরে ত্রাণনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বসতবাড়িটিও অযত্নে ভেঙে পড়েছে। শুধু থেকে গিয়েছে কিছু ইতিহাস। “আজও এই ঘাটকে মানুষ মনে রখেছে ত্রাণনাথ ঠাকুরের ঘাট বলেই। এই পানিহাটি শহরের রূপকার তো তিনিই।” বলছিলেন কেশব মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী সোমা মুখোপাধ্যায়। ত্রাণনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারেই জন্ম তাঁর। আর এই ২৬ বছর ধরে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে পালন করে চলেছেন সেই ঐতিহাসিক প্রথা। ১৮৮০ সালে নদীতীরে যে সুন্দর মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন ত্রাণনাথ ঠাকুর, সেখানে পা পড়েছে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজির মতো মানুষদের। ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট, স্বাধীনতার আগের দিন এই মন্দিরেই এসেছিলেন গান্ধীজি। ১৯০০ সালে ত্রাণনাথ ঠাকুরের উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল পানিহাটি পুরসভা। ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য পৃথক স্কুল তৈরি করেছিলেন তিনি। পানিহাটির সার্থক রূপকার তিনি। তবে তার ইতিহাস আজ অনেকটাই বিস্মৃত। শুধু প্রতি বছর প্রতিমা নিরঞ্জনের রেওয়াজ ধরে রেখেছেন কেশব মুখোপাধ্যায়, তাঁর পরিবার এবং পানিহাটির অসংখ্য সাধারণ মানুষ।

ঠিক সন্ধে নামার মুখে ত্রাণনাথের ঘাটে ভিড়ল ৪টি নৌকো। পানিহাটির মানুষ কাঁধে করে প্রতিমা নিয়ে এলেন ঘাটে। দুটি নৌকোয় তোলা হল প্রতিমা। আলোর রোশনাইতে সাজিয়ে দেওয়া হল চালচিত্র। আর বাকি দুটি নৌকোয় ভাগ করে উঠলেন পুজোর উদ্যোক্তারা। “অন্যান্য বছর দুটো লঞ্চ ভাড়া নেওয়া হয়। শতাধিক মানুষ ভিড় করেন তাতে। এবছর মহামারীর জন্য সেটা সম্ভব হল না। কিন্তু এতদিনের রীতি তো বন্ধ করা যায় না।” বলছিলেন সোমা মুখোপাধ্যায়। কথায় কথায় অন্ধকারে নদীর জল কাটতে কাটতে এগিয়ে চলল ৪টি নৌকো। প্রথমে দক্ষিণে দক্ষিণেশ্বর অবধি এগিয়ে ঘুরল নৌকোর মুখ। তারপর আবার ব্যারাকপুর অবধি গিয়ে দক্ষিণে মুখ ঘুরল। একেকটি ঘাটে মানুষ এসে দাঁড়িয়েছিলেন ঐতিহাসিক এই দৃশ্যের সাক্ষী হতে। আর বিকেল সাড়ে ৪টের কিছু পরে শুরু হয়েছিল যাত্রা। রাত প্রায় ৮টার সময় ত্রাণনাথ ঠাকুরের ঘাটে এসে নিরঞ্জন হল প্রতিমার। সমবেত মানুষ শুধু অস্ফুটে বলে উঠলেন, ‘আবার এসো মা’।

Powered by Froala Editor

More From Author See More