গুপ্তচরবৃত্তির 'অপরাধ'-এ বানরের ফাঁসি!

কানায় কানায় ভর্তি স্টেডিয়াম। ফুটবল খেলা চলছে। পিন পড়া নিস্তব্ধতা স্টেডিয়াম জুড়ে। তবে একপক্ষ গোল দিতেই, সমর্থকদের গলা ফাটানো চিৎকারে গম গম করে উঠল স্টেডিয়াম। ‘হু হ্যাজ হাং দ্য মাঙ্কি? হু হ্যাজ হাং দ্য মাঙ্কি? (Who has hung the monkey) 

কথাটার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘বানরকে কে ফাঁসি দিয়েছে?’ ফুটবল স্টেডিয়ামে এমন আশ্চর্য শব্দবন্ধ শুনলে অবাক লাগাই স্বাভাবিক। আসলে কলকাতা ডার্বি হলেই যেমন আকাশ-বাতাস ভরে যায় ‘লোটা’, ‘মাচা’-র মতো শব্দোচ্চারণে, ঠিক তেমনই ব্রিটিশ ফুটবল ক্লাব হার্টলিপুল ইউনাইটেড এবং ডার্লিংটনের ম্যাচে শোনা যায় ‘হু হ্যাজ হাং দ্য মাঙ্কি’ শব্দবন্ধটি। ব্রিটেনে এই বাক্যটি ব্যবহৃত হয় হার্টলিপুল ইউনাইটেডের সমর্থকদের কটূক্তি করার জন্য। কিন্তু কটূক্তি বা হেয় করার জন্য কেন বেছে নেওয়া হল এই বিশেষ শব্দটিকে?

উত্তর খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় দুশো বছর। আসলে এই মুখচলতি কথার পিছনে লুকিয়ে রয়েছে এক আশ্চর্য ইতিহাস। যুক্তরাজ্যের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত এই ছোট্ট শহরেই (Hartlepool) একসময় সত্যি সত্যিই ফাঁসিতে চড়ানো হয়েছিল একটি বানরকে। অভিযোগ উঠেছিল, নিরীহ বন্যপ্রাণীটিই নাকি ফরাসিদের গুপ্তচর। 

খুলে বলা যাক বিষয়টা। যে-সময়ের কথা হচ্ছে, সেটা উনিশ শতকের শুরুর দিক। নেপোলিয়ান বোনাপার্টের ফ্রান্সের সঙ্গে ইতিমধ্যেই প্রথম পর্বের যুদ্ধ হয়ে গেছে ব্রিটেনের। তবে নেপোলিয়ান যে আবার নৌবাহিনী নিয়ে হানা দিতে পারে ব্রিটিশ মুলুকে, সেই সম্ভাবনা তো রয়েছেই। এর মধ্যেই ঘটে যায় এক আশ্চর্য ঘটনা। পূর্ব উপকূলের হার্টলিপুলের সমুদ্রতটে ভেসে আসে প্রকাণ্ড এক ফরাসি জাহাজের মৃতদেহ। 

হ্যাঁ, ‘মৃতদেহ’ বলাই শ্রেয়। কারণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো কারণে জাহাজডুবির শিকার হয়েছিল ফরাসি জলযানটি। তারপর সমুদ্রের স্রোতে ভেসে তা আছড়ে পড়ে হার্টলিপুল সমুদ্রতটে। আশ্চর্যের বিষয় হল, জাহাজের সমস্ত নাবিকই প্রাণ হারিয়েছিলেন এই দুর্ঘটনায়। হয়তো বা কেউ প্রাণে বাঁচলেও, দুর্ঘটনাস্থল থেকে পালিয়েছিলেন ডিঙ্গিতে চেপে। অন্যদিকে জাহাজের ধ্বংসস্তূপ থেকে একমাত্র জীবিত প্রাণী হিসাবে উদ্ধার করা হয়েছিল একটি বানরকে। তার পরনে ছিল নেপোলিয়নের সেনাদের মতো লাল ও নীল রঙের বাহারি পোশাক। মাথায় টুপি। ব্যাপার কী? এই বানর তবে কি ফরাসিদের গুপ্তচর? পরিকল্পনা মাফিক ব্রিটিশ মুলুক থেকে গোপন তথ্য জোগাড় করার জন্যই কি তবে পাঠানো হয়েছে তাকে?

এমনই আশ্চর্য এক আশঙ্কা জেগেছিল হার্টলিপুলের বাসিন্দা তথা ব্রিটিশ প্রশাসনের মনে। ফলে জাহাজ থেকে গ্রেপ্তার করে আনার পর আদালতে তোলা হয়েছিল অবলা জীবটিকে। শুরু হয়েছিল তার বিচার। তবে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারকের একটি প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারেনি এই ‘ফরাসি গুপ্তচর’। বা, তৎকালীন ব্রিটিশ যাজকের কথায় বলতে গেলে, ‘উত্তর দিতে চায়নি’। ফলস্বরূপ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় তাকে। অবশ্য এই রায়ের পরেও তার চেহারা, অঙ্গভঙ্গিতে একটুকু পরিবর্তনের ছাপ পড়েনি, এমনটাই জানা যায় তৎকালীন নথি থেকে। এরপর টেনে হিঁচড়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হার্টলিপুলের টাউন স্কোয়ারে। মাঝরাস্তায় জনসমক্ষে ফাঁসিতে চড়ানো হয় বানরটিকে। 

এ তো গেল ‘হু হ্যাজ হাং দ্য মাঙ্কি’-র কিংবদন্তি। কিন্তু কীভাবে জাহাজের মধ্যে হাজির হয়েছিল এই বানরটি? কেনই বা তার শরীরে ছিল ফরাসি সেনার পোশাক? আসলে, সে-যুগে ম্যাসকট হিসাবে ফরাসি জাহাজে ব্যবহৃত হত বিভিন্নরকম প্রাণী। তাদের সাজানোও হত মানুষের মতো করে। এই বানরটিও ছিল তেমনই একটি ম্যাসকট। জাহাজ ডুবির পর যা কোনোক্রমে বেঁচে গিয়েছিল ভাসমান কাঠে চেপে। 

তবে এই ঘটনার আরও একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কিছু কিছু কনস্পিরেসি থিওরিস্টদের মুখ থেকে। তাঁদের কথায়, সে-যুগে ফরাসি নৌবাহিনীর জাহাজে কাজ করতেন বহু অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর। মূলত তাদের কাজ ছিল, জাহাজের কামানে গোলাবারুদ ভরা এবং আদেশ পেলে সেখানে অগ্নিসংযোগ ঘটানো। সে-যুগে তারা পরিচিত ছিল ‘পাউডার মাঙ্কি’ নামে। সম্ভবত এমনই একজন কিশোরকেই ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল হার্টলিপুলে। তেমনটা হলে, তার শরীরে ফরাসি সেনার পোশাক থাকাই স্বাভাবিক। এমনকি ব্রিটিশ উচ্চারণ বুঝতে পারেনি বলেই কোনো উত্তর দেয়নি সে আদালতে। তবে কিশোর হত্যার এই লজ্জাজনক ঘটনাটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই পরবর্তীতে সাজানো হয় বানরের গল্প। সেইসঙ্গে সমস্ত নথি থেকে মুছে ফেলা হয় তারিখ। এমনটাই অভিমত একদল কনস্পিরেসি থিওরিস্টদের। যদিও তার স্বপক্ষে কোনো পাকা প্রমাণ আজও নেই মানুষের কাছে। 

অন্যদিকে হার্টলিপুলে আজও পথেঘাটে শোনা যায় এই কিংবদন্তি। প্রাণী অধিকারীকর্মীদের সৌজন্যে শহরের বুকে তৈরি হয়েছে প্রমাণ আকারের একটি স্ট্যাচুও। প্রতিবছর যেখানে ‘পাপস্খলন’-এর জন্য প্রয়াত বানরকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন হার্টলিপুলের বাসিন্দারা। পাশাপাশি ২০০৪ ও ২০০৯ সালে এই শহরের মেয়র নিজে খোদ নির্বাচনী প্রচারের নেমেছিলেন ঐতিহাসিক এই বানরের পোশাক পরে। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ভোটে জিতলে এলাকার সমস্ত স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে কলা বিতরণ করবেন তিনি। এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, আজও হার্টলিপুলে কতটা জনপ্রিয় ‘হ্যাঙ্গাস দ্য মাঙ্কি’-খ্যাত এই বানর।

Powered by Froala Editor