ফ্রি-কিক নেওয়ার আগেই বল ক্লিয়ার! বিশ্বকাপে যে ঘটনা অবাক করে দিয়েছিল রেফারিকেও

পেনাল্টি বক্সের ঠিক বাইরেই ফ্রি-কিক। গোলের সামনে পাঁচিল তুলেছেন ডিফেন্ডাররা। অন্যদিকে লক্ষ্যভেদের জন্য প্রস্তুত ব্রাজিলের রিভেলিনো। সে-ম্যাচে তখনও পর্যন্ত ৩ গোলে এগিয়ে রয়েছে সেলেকাওরা। তবে সেই ব্যবধান যে আরও বাড়তে পারে, তা মুহুর্মুহু বুঝিয়ে দিচ্ছিল ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের অ্যাটাক। যাই হোক, রেফারির বাঁশি বাজল। তবে রিভেলিনো ফ্রি-কিক নেওয়ার আগেই মানবপ্রাচীর থেকে বিপক্ষের এক ডিফেন্ডার ছুটে এসে উড়িয়ে দিলেন মাঠে রাখা বল।

১৯৭৪ সাল। পশ্চিম জার্মানিতে আয়োজিত বিশ্বকাপে (FIFA World Cup) এমনই আশ্চর্য এক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল গোটা বিশ্ব। রিভেলিনো, গ্যালারিতে উপস্থিত দর্শকরা তো বটেই, এমন আশ্চর্য ঘটনায় অবাক হয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং রেফারিও। এই আচরণের জন্য সংশ্লিষ্ট ডিফেন্ডারকে হলুদ কার্ড দেখাতে বাধ্য হন ম্যাচ অফিসিয়াল। কিন্তু হঠাৎ এভাবে বল ক্লিয়ার করার কারণ কী? তবে কি তিনি বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে খেলতে নেমেও ফুটবলের নিয়মাবলি জানতেন না? 

না, ব্যাপারটা তেমন নয়। আসলে সেবারই প্রথমবারের জন্য বিশ্বকাপের যোগ্যতা পেয়েছিল জাইরে (Zaire)। যদিও এই নামে বর্তমান বিশ্ব-মানচিত্রে কোনো দেশ নেই। আজ সেই দেশ ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো। যে-সময়ের কথা হচ্ছে, তখনও পর্যন্ত কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হয়ে ওঠেনি। সে-দেশের ‘সিংহাসন’ রয়েছে স্বৈরশাসকের হাতের মুঠোয়। ফলে প্রথম বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জনের উচ্ছ্বাস ঢাকা পড়ে গিয়েছিল স্বৈরশাসকের চাপে। দেশের সর্বাধিনায়ক প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া খেলোয়াড়দের ‘আদেশ’ দিয়েছিলেন যেন-তেন-প্রকারেণ ঘরে তুলতে হবে কাপ। 

তবে ছোট্ট একটি আফ্রিকান দেশের স্বৈরশাসকের কথায় কি আর পৃথিবী চলে? ফলে, তেমনটা একেবারেই হয়নি। বিশ্বকাপের মূল মঞ্চে খেলতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আফ্রিকার দেশটি। স্কটল্যান্ড, যুগোশ্লাভিয়া এবং ব্রাজিল— এই তিনটি দেশের সঙ্গে গ্রুপ পর্বের ম্যাচ পড়েছিল জাইরের। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল এবং তৎকালীন সময়ের ফুটবল পাওয়ার হাউস যুগোশ্লাভিয়াকে হারানো ছিল প্রায় অসম্ভব কাজ। ভরসা ছিল কেবলমাত্র স্কটল্যান্ড। তবে হাতছাড়া হয় সেই ম্যাচও। 

প্রথম ম্যাচেই স্কটিসদের কাছে ২-০ ব্যবধানে হেরেছিল আফ্রিকান দেশটি। এই লজ্জা আরও বাড়ে দ্বিতীয় ম্যাচে। স্লাভদের কাছে ৯ গোলের মালা পরতে হয়েছিল জাইরেকে। এরপরই নাটকীয় মোড় নেয় পরিস্থিতি। দেশ থেকে ফুটবলারদের বিশেষ বার্তা পাঠান জাইরে-প্রেসিডেন্ট মোবুতু। কড়া ভাষায় জানিয়েছিলেন, ব্রাজিলের বিরুদ্ধে ৩টির বেশি গোল হজম করলে জীবিত অবস্থায় কোনো খেলোয়াড় দেশে পা রাখতে পারবে না। 

জোসেফ এমওয়েপু ইঙ্গুলা 

 

নিজেদের প্রাণ বাঁচাতেই সেদিন মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছিল জাইরে। তবে লাভ হয়নি খুব একটা। ১২ মিনিটের মাথায় জারজিনহোর গোলে লিড নেয় ব্রাজিল। দ্বিতীয়ার্ধে আরও দুটি গোল করেন রিভেলিনো ও ভালদোমিরো। ৭৯ মিনিটের মধ্যেই ৩ গোলের কোটা পূরণ করে দেয় ব্রাজিল। তখন খানিক ঝিমিয়ে পড়েছে জাইরে ডিফেন্ডাররা। অন্যদিকে ক্রমাগত আক্রমণ শানিয়ে যাচ্ছে ব্রাজিল। এর মিনিট তিনেকের মাথাতেই বক্সের বাইরে জারজিনহোকে আটকাতে গিয়ে ফাউল করে বসেন জাইরে ডিফেন্ডাররা। ফ্রি-কিক পায় ব্রাজিল। 

এই অবস্থান থেকে অনায়াসেই গোল করতে পারেন সে-যুগের সেট-পিস স্পেশালিস্ট রিভেলিনো, তা অজানা ছিল না কারোরই। কাজেই হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল জাইরের খেলোয়াড়দের। আর একটি গোল হজম করার মানে খোদ মৃত্যুদূতকে স্বাগত জানানো। এই প্রবল মানসিক চাপ সহ্য করতে পারেননি জাইরে ডিফেন্ডার জোসেফ এমওয়েপু ইঙ্গুলা। রেফারির বাঁশি বেজে ওঠার পরই, গোল হজমের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে মানবপ্রাচীর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসেন তিনি। রিভেলিনো শট করার আগেই ক্লিয়ার করে দেন বল। 

জোসেফের হলুদ কার্ড দেখার কয়েক মুহূর্ত পরেই প্রকাশ্যে আসে এই ঘটনা। না, সেবার আর গোল-ব্যবধান বাড়েনি ম্যাচের। সংশ্লিষ্ট ফ্রি-কিকটি বাইরে মেরেছিলেন রিভেলিনো। শেষ পনেরো মিনিট খেলাও চলেছিল ঢিমে তালে। অন্যদিকে প্রাণ হাতে নিয়েই দেশে ফিরতে পারেছিলেন আফ্রিকান ফুটবলাররা। তবে বিতর্কের এখানেই শেষ নয়। ফুটবলারদের জন্য ফিফার বরাদ্দ করা বাসটিও দেশে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন স্বৈরশাসক মোবুতু। অবশ্য শেষ অবধি সেক্ষেত্রে বাধ সাধে ফিফা ও পশ্চিম জার্মানির কর্তৃপক্ষ। সেই গল্প না হয় বলা যাবে অন্য একদিন…

Powered by Froala Editor

More From Author See More