কলকাতায় বাঙালি ব্যবসায়ীর বাড়িতে হামলা সাহেব ডাকাতের, বিচারে শাস্তি প্রকাশ্যে ফাঁসি

কলকাতা তখন এক নতুন নগর। সেইসঙ্গে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সদর দপ্তর। কলকাতাকে ঘিরে জন্ম নিচ্ছে কত নতুন নতুন ব্যবসা। সেই ব্যবসায় পা বাড়িয়েছিলেন এক ধনী বাঙালিও। নাম চৈতনশীল। চিনা বাজার এলাকায় দোকান ছিল তাঁর। আর ছিল বিরাট এক বসতবাড়ি। সেই চৈতনশীলের বাড়িতেই ডাকাত পড়ল একদিন। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে দেখলেন, তাঁর বাড়ির সদর দরজা খোলা। চাকরবাকরদের কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কলকাতায় তখন ডাকাতিও একটি রোজকার ঘটনা বলা যায়।

আরও পড়ুন
অভিনয় করেছেন রবীন্দ্রনাথ, দর্শকাসনে নেতাজিও – থামল কলকাতার রক্সি সিনেমা হলের যাত্রা

ডাকাতি আমরা কেউই নিজের চোখে দেখিনি। তবে গল্প-কাহিনিতে ডাকাতির বর্ণনা পড়েছি। তাই ডাকাতির কথা বললেই একটা পরিচিত ছবি ভেসে ওঠে। বিরাট বাহিনীর নেতৃত্বে এক সর্দার। আর দলের প্রত্যেকের হাতে লাঠি। কারোর হাতে বল্লম, কারোর হাতে খাঁড়া। সর্দারের চেহারাও বেশ পরিচিত। লম্বা চওড়া গড়ন। গায়ের রং কুচকুচে কালো। আর ইয়া মোটা একটা গোঁফ। এই পরিচিত ছবির সঙ্গে কিন্তু চৈতনশীলের বাড়ির ডাকাতি মেলে না একেবারেই। কারণ তাঁর বাড়িতে হানা দিয়েছিল সাহেব ডাকাতদের একটি দল। দলের সর্দার যদিও বাঙালি, কিন্তু বাকি সদস্যরা প্রত্যেকেই এসেছেন ইউরোপ থেকে।

আরও পড়ুন
মর্ত্যেই রয়েছে ‘কৈলাস’, কলকাতার বুকে আশ্চর্য কীর্তি মহারাজা জয়নারায়ণের

হ্যাঁ, সাহেব বলতে আমরা যদি শুধু আমলা বা পুলিশ বুঝি, তাহলে একটু ভুল হবে। ইউরোপের অনেক বেকার যুবক ভাগ্যান্বেষণের জন্য চলে আসতেন উপনিবেশে। ছোটোখাটো নানা কাজ নিয়েই লেগে পড়তেন তাঁরা। আর সেইসব কাজের সুযোগও যাঁরা পেতেন না, তাঁদের অনেকেই বেছে নিতেন বিকল্প নানা জীবিকা। যেমন বেছে নিয়েছিল এই কাহিনির ডাকাতরা। সুপ্রিম কোর্টের এজলাসে উঠেছিল ৬ জন ডাকাতের নাম। রুশো, বুফাস, জারান, ট্রাঙ্ক, কোয়েল এবং ফ্যাসিনেত। এদের মধ্যে কেউ পর্তুগিজ, কেউ ইতালীয়, কেউ আবার ইংরেজ। আর তাদের নেতৃত্বে কিন্তু এক বাঙালি। দস্যু মোহনপাল। মোহনপালের এই দলে শতাধিক ডাকাত ছিল। আর তারা প্রত্যেকেই ইউরোপীয়।

আরও পড়ুন
কলকাতার দোকানে বিক্রি হবে সুন্দরবনের বাঘ, ২২০ বছর আগের বিজ্ঞাপন

অতঃপর মাঘ মাসের শীতের রাতে চৈতনশীলের বাড়িতে ডাকাত পড়ল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় তিনি দেখলেন, বাড়ির সদর দরজা খোলা। অনুমানে বুঝলেন সে দরজা ভাঙা হয়েছে। চাকরবাকরদেরও সাড়া মেলে না। বাইরে এসে দেখলেন তেরো-চোদ্দজন সাহেব বাড়িটি ঘিরে ফেলেছে। দু-তিনজনের হাতে আবার জ্বলন্ত মোমবাতি। ডাকাতরা গুদামের দরজা ভাঙল, তাঁর শোবার ঘরেও ঢুকে পড়ল। সিন্দুক ভেঙে সোনা রুপার সরঞ্জাম যা পেল নিয়ে গেল। চৌকির উপর কতগুলি নতুন কাপড় ছিল। ডাকাতরা যাওয়ার সময় সেগুলোও নিয়ে গেল।

আরও পড়ুন
অবাঙালির কাছে বিক্রি বাড়ি, মৃত্যুর চার বছরের মধ্যেই ভাঙা হল অমল দত্তের বাসগৃহ

তবে, রেহাই পায়নি তারা। ধরা পড়েছিল ঠিকই। তাও এক বাঙালি গোয়েন্দার তৎপরতায়। ৬ মার্চ ১৭৯৫, জাস্টিস অফ পিস মিস্টার স্মিথের কাছ থেকে একটি ওয়ারেন্ট পেলেন সার্জেন অগিলবি। ওয়ারেন্টে আদেশ ছিল রুশোকে গ্রেপ্তার করার। আর রুশোকে গ্রেপ্তার করতেই একে একে বাকিরাও ধরা পড়ল।

আরও পড়ুন
কলকাতার কেবিনগুলিতে বসত বিপ্লবীদের বৈঠক, ছিল পালানোর গোপন পথও

এক ডাকাত, নাম জারান, রাজসাক্ষী হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। তার জবানি থেকেই জানা যায় ডাকাতদের ভয়ঙ্কর পরিকল্পনার কথা। দস্যু মোহনপালের নেতৃত্বে তারা নাকি হিন্দুস্থান ব্যাঙ্ক লুঠ করার পরিকল্পনাও করেছিল। অবশ্য তার আগেই ধরা পড়ে যাওয়ায় সেই পরিকল্পনা আর বাস্তবায়িত হয়নি।

আরও পড়ুন
১৮৮১ নয়, তার পাঁচ বছর আগেই কলকাতা শুনেছিল প্রথম টেলিফোনের আওয়াজ

কলকাতার সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার বিচার চলেছিল মাত্র ১৬ ঘণ্টা। অবশ্য সেকালের বিচারব্যবস্থায় এও এক বিরাট সময়। সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে জুরিরা একবাক্যে স্বীকার করেন যে, আসামীরা প্রত্যেকেই দোষী। একমত হলেন চিফ জাস্টিস মিস্টার হাইডও। তখনকার দিনে ডাকাতির শাস্তি ছিল ফাঁসি। দস্যু মোহনপাল সহ সাতজনের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হল। আর অন্যান্য ডাকাতদের মধ্যে ভয় প্রদর্শনের জন্য ফাঁসি দেওয়া হল প্রকাশ্যে। চৈতনশীলের বাড়ির কাছেই ছিল একটা বাজার। সেখানেই ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল ডাকাতদের।

আরও পড়ুন
কলকাতায় ইংরেজদের তৈরি প্রথম গির্জা আজ বিস্মৃতির অতলে

সাহেবরা এদেশের বহু সম্পদ লুঠ করেছে। সাহেব কোম্পানিদের হাতেই ধ্বংস হয়েছে এদেশের অর্থনীতির চেহারা। কিন্তু সেসবই হয়েছে দীর্ঘ বাণিজ্যিক পরিকল্পনার মাধ্যমে। সাহেব বলতে কিন্তু আমরা আমলা আর পুলিশই বুঝি। অথবা খুব বড় মাপের কোনো ব্যবসাদার। তবে কলকাতার বুকে এমন সাহেবি ডাকাতির কাহিনি অবাক করে বৈকি! তাও আবার সেই আমলে, যখন ইংরেজদা ধীরে ধীরে গড়ে তুলছে কলকাতা শহরকে। আশ্চর্য গল্প, না?

তথ্যসূত্র: কলিকাতা সেকালের ও একালের, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়
ছবি - প্রতীকী

More From Author See More