‘এ দেশে হতভাগা মানুষের সমস্ত প্রাপ্য দেবতা নিচ্চেন হরণ করে’, ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসে পরেশবাবুর উক্তি করেছিলেন, “ভারতবর্ষে হিন্দু কমছে, আর মুসলমান বাড়ছে। এইরকম ভাবে চললে এদেশ মুসলমান প্রধান হয়ে উঠবে, তখন একে হিন্দুস্তান বলাই অন্যায় হবে।” বলাই বাহুল্য, বর্তমানে এইসকল পরেশবাবুদের সংখ্যা দেশে যথেষ্টই বেড়েছে বই কমেনি! স্বদেশি সমাজের পরিশিষ্টে তাই রবীন্দ্রনাথ যখন লেখেন, “হিন্দু সমাজকে জাগ্রত হইতে হইবে, কর্তৃত্ব গ্রহণ করিতে হইবে”, তখন তা যে আদতে আরও মারমুখী হিন্দুত্বের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার কথা না বলে বরং মহান সহনশীলতার কথাই বলতে চায়, সেই ভাবনাও যেন গুলিয়ে দেওয়া হয় ধর্মান্ধতার জিগিরে।

ফিরে যাওয়া যাক রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর দশ বছর আগে। ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ ভ্রমণের কালে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনা ঘটেছিল। তার মধ্যে একটি ছিল আইনস্টাইনের সঙ্গে কবিগুরুর সাক্ষাৎ। অন্যটি ছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ‘হিবার্ট’ বক্তৃতা প্রদান এবং ছবির প্রদর্শনী।

রবীন্দ্রনাথের হিবার্ট বক্তৃতার বিষয় ছিল `দ্য রিলিজিয়ন অফ ম্যান’, যা পরে ‘মানুষের ধর্ম’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইতে রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তি মানুষের ক্ষেত্রে দু’রকম ধর্মের অস্তিত্বের কথা বলেছিলেন। প্রথমটি হল প্রাকৃতিক এবং জৈব ধর্ম, যেখানে শারীরিক প্রয়োজনটাই সব। অন্য ধর্মটি হল, জাগতিক জীবসত্তাকে ছাড়িয়ে মানসধর্মের জাগরণ, যেখানে প্রাণীজগতের স্বভাবধর্ম থেকে ‘মানুষের ধর্মে’ উত্তরণ ঘটে মানবজাতির। এই তার দ্বিতীয় ধর্ম। 

উপনিষদের আলোকে উজ্জ্বল রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিসত্তাকে বলেছেন ‘অহং’ আর ব্যক্তির ভিতরের অন্তর্গত সত্তাকে অভিহিত করেছেন ‘আত্মা’। ছবির মতো করে দেখিয়েছেন, ব্যক্তিসত্তাকে যদি প্রদীপ বলা হয়, তবে আত্মা হচ্ছে তার শিখা! এই শিখা জ্বালানোর কথাই বারবার বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। ধর্মের মূল সুরটি নিহিত আছে সেখানেই— ধর্ম, অর্থাৎ, ধারণ করে আছে যা।

এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী রবি ঠাকুরের পূজা পর্যায়ের গানগুলোতেও কোনও নির্দিষ্ট দেবদেবীর নাম পাওয়া যায় না। যুক্তিবাদের প্রয়োগের উপর গুরুত্ব দিতেন তিনি। যুক্তি দিয়ে বিচার করেই তিনি হিন্দু ধর্ম ও সামাজিক রীতিনীতিগুলি সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তবে তার জন্য হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করে অন্য কোনও ধর্ম গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা নেই বলেও মনে করেছিলেন তিনি। ধর্মকে তাচ্ছিল্য না করে বরং ধর্মের গোঁড়ামি, আনুষ্ঠানিকতা ও কুসংস্কারগুলি বাদ দিয়ে তিনি গ্রহণ করেছিলেন ধর্মের সার্বিক শিক্ষাগুলি।

দেশে-বিদেশে লাগাতার ভ্রমণ যে তাঁর জানা-বোঝার পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছিল নানা অর্থেই, সে কথা বারবারই জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই। হেগেল, ফ্রয়েড, এঙ্গেলস, কার্লমার্ক্সের মতো আধুনিক চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের ভাবনায় প্রভাবিত রবীন্দ্রনাথ নিজেকে আবিষ্কার করার চেষ্টাও করেন নতুন করে। নতুন আলোয় চেনার চেষ্টা করেও ধর্মকেও। কখনোই অন্ধ অনুকরণ নয়, বরং যে কোনও কিছু গ্রহণ বা বর্জনের ক্ষেত্রে যুক্তি এবং বিশ্লেষণকেই প্রাধান্য দিতেন তিনি। ধর্মের ক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি তার। নানা লেখাপত্রে পরবর্তীকালে দেখা গিয়েছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেকে একজন খাঁটি হিন্দু বলে পরিচয় দিয়েছেন কিন্তু একই সঙ্গে কখনোই বর্জন করেননি তাঁর ব্রাহ্মধর্মের উপর বিশ্বাসকেও। বস্তুত, হিন্দুধর্ম ও ব্রাহ্মধর্ম যে পরস্পরের মধ্যে বিরোধ নেই অথবা সনাতন হিন্দুধর্মের আধুনিক সংস্করণ হল ব্রাহ্মধর্ম, প্রকারান্তরে এটাই যেন তিনি বলতে চেয়েছেন।

আরও পড়ুন
নিমতলায় পৌঁছোতেই পারেননি কবিপুত্র, রবীন্দ্রনাথের মুখাগ্নি করলেন কে?

১৩৪১ সালের ‘প্রবাসী’ পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, “আমি বলছি, যা কিছু মানুষের শ্রেষ্ঠ আদর্শের সঙ্গে মেলে তাই হিন্দুধর্ম। কেননা, হিন্দুধর্মে জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম তিন পন্থাকেই ঈশ্বরের সঙ্গে যোগের পন্থা বলেছেন। খ্রিষ্টান ধর্মের চেয়ে হিন্দুধর্মের একটা জায়গায় শ্রেষ্ঠত্ব এই দেখি, হিন্দুধর্ম সন্ন্যাসবাদ ধর্ম নয়। ...হিন্দুধর্মকে বাইরের দিকে যে সব স্থূল আবরণে আবৃত করেছে, তাকে বাদ দিয়ে যে জিনিষটাকে পাই সে তো কোনো ধর্মের চেয়ে কোনো অংশে নিকৃষ্ট নয়। কেননা, এতে মানুষের হৃদয়, মন, আত্মা এবং কর্মচেষ্টা সমস্তকেই ভূমার দিকে আহ্বান করেছে। আমি এই জন্যেই হিন্দু নাম ছাড়তে পারিনে, ব্রাহ্মধর্মকে হিন্দুধর্ম থেকে পৃথক করতে পারিনে।”

অথচ যে ১৯৩১ সালে অক্সফোর্ডে ধর্ম বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, তখনও তাঁকে চক্ষুশূল হতে হয়েছে সনাতনীদের। সামলাতে হয়েছে তীব্র প্রতিরোধ, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও। রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখলেন হেমন্তীবালা দেবীকে। চিঠিতেই যেন উগড়ে দিলেন তাঁর বিশ্বাস: ‘...যেখানে মন্দিরের দেবতা মানুষের দেবতার প্রতিদ্বন্দ্বী, যেখানে দেবতার নামে মানুষ প্রবঞ্চিত, সেখানে আমার মন ধৈর্য্য মানে না। ...দেশের লোকের শিক্ষার জন্যে, অন্নের জন্যে, আরোগ্যের জন্যে এরা কিছু দিতে জানে না, অথচ নিজের অর্থ-সামর্থ্য সময় প্রীতি ভক্তি সবই দিচ্চে সেই বেদীমূলে, যেখানে তা নিরর্থক হয়ে যাচ্চে। মানুষের প্রতি মানুষের এত নিরৌৎসুক্য, এত ঔদাসীন্য অন্য কোনো দেশেই নেই, এর প্রধান কারণ এই যে, এ দেশে হতভাগা মানুষের সমস্ত প্রাপ্য দেবতা নিচ্চেন হরণ করে।...’

যে কোনও সময়ে, যে কোনও পরিস্থিতিতে মানুষের থেকে বড় আর কিছুই ছিল না কবিগুরুর কাছে। মানুষকে তিনি রেখেছিলেন সবার উপরে; ধর্মের উপরে, রাষ্ট্রের উপরেও। “যুক্তিহীন অর্থহীন আচারই যে হিন্দু সমাজের প্রকৃতিগত এ কথাকে আমি শেষ পর্যন্তই অস্বীকার করিব,” বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এমনকি যথেষ্ট সম্মান রেখেও গান্ধীজির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বলেছেন, “যুক্তির পরিবর্তে উক্তি তো কোনোমতেই চলবে না। মানুষের মুখে যদি আমরা দৈববাণী শুনতে আরম্ভ করি তা হলে আমাদের দেশে, যে হাজার রকমের মারাত্মক উপসর্গ আছে এই দৈববাণী যে তারই মধ্যে অন্যতম এবং প্রবলতম হয়ে উঠবে।”

আরও পড়ুন
বৃষ্টিভেজা শ্রাবণে প্রয়াত রবীন্দ্রনাথ, শেষযাত্রার ধারাবিবরণী দিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র

রবীন্দ্রনাথের ধর্ম ভাবনার মূল উপপাদ্য ছিল, ‘সহজিয়া’। ব্যাখ্যা করে লিখেছিলেন, ঘরের কুলুঙ্গিতে প্রদীপ জ্বালাতে গেলে তার জন্য নানাবিধ আয়োজন বা উপকরণের জন্য অন্যের শ্রমের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় থাকে না আমাদের। কিন্তু এত জটিলতার পরেও আলো পাওয়া যায় সামান্যই। রয়ে যায় প্রদীপের নীচের অন্ধকার অংশটিও। অথচ দিনের বেলায় আলো পেতে গেলে এত জটিলতার প্রয়োজন পড়ে না; বরং চোখ মেলে দিয়ে ঘরের দরজা-জানলাগুলো খুলে দিলেই আলোর ঝরনা ঝাঁপিয়ে পড়ে চতুর্দিকে। চুম্বকে, ধর্ম নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মূল ভাবনার জায়গা ছিল এটাই। বিশেষ আয়োজনের মাধ্যমে ধর্মকে পেতে বা উপলব্ধি করতে আপত্তি ছিল রবীন্দ্রনাথের। বরাবর বিশ্বাস করে এসেছিলেন, 'বৃহৎ আলোক আমাদের মস্তকের উপর আপনি বর্ষিত হইয়া থাকে; ক্ষুদ্র আলোকের জন্যই অনেক কলকারখানা প্রস্তুত করিতে হয়।'

দিনেকালে ধর্মের জটিলতা এবং সর্বগ্রাসী মনোভাব বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল রবীন্দ্রনাথকে। তন্ত্র মন্ত্র, জটিল ক্রিয়াকর্ম এবং ব্রাহ্মণ্যবাদ সনাতন হিন্দু ধর্মের পিছনে হাঁটার রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিল বলে মনে করেছিলেন তিনি। সেই সঙ্গেই ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ে ও মতবাদের সংঘর্ষে সারা বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় হানাহানি, গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িকতা নাড়া দিয়েছিল কবিগুরুর দার্শনিক মননকে। নিজেরা ধর্মের অনুগত না হয়ে নিজস্ব প্রয়োজনে ধর্মকে ব্যবহার করা এবং নিজের মতো করে ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা সামনে নিয়ে আসার প্রচেষ্টাই এর জন্য দায়ী বলে মনে করেছিলেন তিনি।

‘কালান্তর’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃত ধর্ম আর আচার-সর্বস্ব ধর্ম বা ধর্মতন্ত্রের বৈপরীত্য দেখিয়েছেন উদাহরণ দিয়ে। 'ধর্ম বলে, অনুশোচনা ও কল্যাণ কর্মের দ্বারা অন্তরে বাহিরে পাপের শোধন। কিন্তু ধর্মতন্ত্র বলে, গ্রহণের দিনে বিশেষ জলে ডুব দিলে, কেবল নিজের নয়, চোদ্দপুরুষের পাপ উদ্ধার।’ কী ভীষণ প্রাসঙ্গিক মনে হয় না এখনকার দিনে দাঁড়িয়ে?

আরও পড়ুন
মসজিদে পৌঁছলেন রবীন্দ্রনাথ, রাখির বাঁধনে জড়িয়ে নিলেন মৌলবীদেরও

তাই এখন যখন ভারতেরই একটি বিন্দুতে ভগবানের জন্মস্থান চিহ্নিত করতে টালমাটাল হয়ে উঠেছে রাজনীতির উঠোন, যখন সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্ফালনে সন্ত্রস্ত হয়ে সেই সম্প্রদায়েরই কেউ কেউ বলে ফেলছেন, সংখ্যাগুরু সেই দলের থেকে বাদ রাখা হোক তাদেরকে, তখনও রবীন্দ্রনাথ ভেসে ওঠেন অবচেতনে। যেন মনে করিয়ে দেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের দলে টানতে চেষ্টা করা হলেও তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যারা আওয়াজ তোলেন, তাদের কথা: “আমি হিন্দু, এ-কথা বলিলে যদি নিতান্তই কোনো লজ্জার কারণ থাকে তাহলে সে লজ্জা আমাকে নিঃশব্দে হজম করিতেই হইবে।” ‘আত্মপরিচয়’ রচনার এই অংশটুকুই যেন কীভাবে ছবি হয়ে দাঁড়ায় বর্তমানে জাতীয় প্রেক্ষাপটের। এভাবেই তাই প্রায় আশিটা ২২শে শ্রাবণ কেটে গেলেও, এখনও একই ভাবে প্রাসঙ্গিক থেকে যান রবীন্দ্রনাথ।

Powered by Froala Editor

More From Author See More