লকডাউনে শিক্ষা দিতে ‘ব্যর্থ’ সরকারি স্কুলগুলি, বন্ধের মুখে বেসরকারি স্কুলও - এমনটাই জানাচ্ছে সমীক্ষা

ভারতে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভাজন যে কতটা প্রকট, তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে দিল করোনা অতিমারই। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘অক্সফাম ইন্ডিয়া’র সমীক্ষায় দেখা গেছে, লকডাউনের সময় সঠিকভাবে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষা পায়নি বলে জানিয়েছেন ৮০ শতাংশেরও বেশি অভিভাবক। এই ব্যর্থতার মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে, ভারতের গ্রামীণ পরিবারগুলির মধ্যে কেবল মাত্র ১৫ শতাংশ পরিবারই ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা পায়। সরকারের নিজের তথ্যই বলছে, এই সংখ্যা প্রান্তিক সামাজিক গোষ্ঠী, যেমন দলিত, আদিবাসী ও মুসলিমদের মধ্যে আরও কম। এছাড়াও লকডাউনের সময় দেখা গিয়েছে লিঙ্গ ভিত্তিক বৈষম্যও। পড়াশোনা থেকে অনেকটাই দূরে সরে যেতে দেখা গিয়েছে মেয়েদের। সেই সঙ্গেই লকডাউনের সময় বাল্যবিবাহের পরিমাণ যে হারে বেড়েছে, তা বারবারই উঠে এসেছিল সংবাদমাধ্যমে। 

অভিভাবকেরা জানিয়েছেন লকডাউনের সময় কীভাবে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাতে হবে, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনও নির্দেশিকা বা গাইডলাইন তাঁদের কাছে ছিল না। তাছাড়াও অনলাইন শিক্ষার জন্য প্রয়োজন বিশেষ স্টাডি মেটেরিয়াল। সেই সবেরও বালাই ছিল না কোনও। শিক্ষক-শিক্ষিকারই জানাচ্ছেন যে, অনলাইন ক্লাস শুরু করার আগে যে বিশেষ পাঠ্যপুস্তক ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে পৌঁছানো জরুরি তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পৌঁছয়নি। সুতরাং শিক্ষকদের কাছে ব্যাপারটি এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষা প্রদান নয়, বরং ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং তাদের পড়াশোনার মতো কিছু কার্যকলাপে জড়িয়ে রাখার চেষ্টা করা।

এর মধ্যে বেসরকারি স্কুলগুলিতেও মহামারীর কোপ পড়েছে। ‘সেরেস্ট্রো ভেঞ্চার্স’ নামের একটি সংস্থার সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বেসরকারি মালিকানাধীন স্কুলগুলিও এখন ক্রেতা খুঁজছেন। অন্যথায় বন্ধ হয়ে যেতে পারে স্কুলগুলি। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় উপার্জনে ঘাটতি পড়েছে। অনেক অভিভাবক নিয়মিত স্কুলের ফি জমা করতে পারেননি। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেতন দিতেও অপারগ অনেক স্কুল। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে দেশের ৮০ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বেসরকারি মালিকানাধীন। সেখানে নূন্যত বার্ষিক বেতন ৫০ হাজার টাকা। অনেক অভিভাবকের পক্ষেই এই পরিস্থিতিতে স্কুলের ফি দেওয়া সম্ভব নয়। পাশাপাশি মালিকপক্ষের অন্যান্য ব্যবসাতেও লোকশান দেখা দিয়েছে। ফলে সেখান থেকে লভ্যাংশ শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়াও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

করোনার কারণে মার্চ মাসে বন্ধ হয়ে যায় ভারতে স্কুলগুলি। তবে জুনের মধ্যে অনলাইন ক্লাস চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এই সময় সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যগুলিকে নির্দেশ দিয়েছিল, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি মধ্যাহ্নভোজের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে লকডাউনের সময় ৩৫ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী বঞ্চিত হয়েছে মধ্যাহ্নভোজ থেকে।

আরও ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে এই সমীক্ষা রিপোর্টে। জানা যাচ্ছে যে, লকডাউনের সময় স্কুলগুলি বন্ধ থাকার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৩০ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী। এর ফলে নিম্ন এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা হারিয়ে ফেলবে ভবিষ্যতে পড়াশোনার সুযোগ। সেইসঙ্গে অবনতি ঘটবে খাদ্য সুরক্ষার যা প্রকারান্তরে বাড়িয়ে তুলবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ। উঠে এসেছে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আশঙ্কার ছবিও। ৪০ শতাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, পুনরায় বিদ্যালয় খুললেও এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী আর বিদ্যালয় ফিরে আসবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে তাঁদের। এর ফলে শিশুশ্রমের ঝুঁকি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে ১০০ শতাংশ।

লকডাউনের সময় যে সকল পরিবারের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা ছিল, সেখানে হোয়াটসঅ্যাপ এবং ফোন-কলের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু ৭৫ শতাংশের বেশি অভিভাবক জানিয়েছেন, ইন্টারনেট সংযোগের ব্যয় বহন করতে অক্ষম হওয়ার কারণে এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারলেও তার দুর্বল গতির ফলে এই অনলাইন শিক্ষা কাজে আসেনি পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদের। এ ছাড়াও বহু পরিবারেই মোবাইল সংযোগ থাকলেও স্মার্ট ফোন না থাকায় ব্যাহত হয়েছে পড়াশোনা। 

আরও পড়ুন
নিত্যনতুন ফ্যাশনে মাতিয়েছেন দেশকে, পারিবারিক শিল্পবোধই কিংবদন্তি করে তুলেছিল কবিকন্যা শর্বরী দত্তকে

তবে শুধুমাত্র শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকেরাই নন, লকডাউনের ফলে অনলাইনে পড়াশোনার ব্যবস্থায় প্রভূত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন শিক্ষক সম্প্রদায়ও। প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা জানিয়েছেন যে, এই ডিজিটাল শিক্ষাদান পদ্ধতিতে রীতিমতো সমস্যায় পড়েছেন তাঁরা। সরকারের তরফে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ডিজিটাল শিক্ষা প্রদান বিষয়ে যে ধারণা দেওয়ার কথা ছিল, তাও দেয়া হয়নি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। ফলে লাভের লাভ যে আদতে কিছুই হয়নি, সে কথা বলাই বাহুল্য।

মিড ডে মিল বন্ধ হবার ফলে শিশুদের স্বাস্থ্যের উপর তার ব্যাপক প্রভাব পড়ার কথাই ছিল। আদতে দেখা গিয়েছে সেটাই। মহামারী জনিত কারণে ভারতে ১০ কোটিরও বেশি শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে বলে জানান দিয়েছে সমীক্ষা। আদিবাসী এবং দলিত সম্প্রদায়ের শিশুরা বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এর ফলে। এছাড়াও, ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অপুষ্টিজনিত কারণে সমস্যার সম্মুখীন হওয়া মেয়েদের ক্ষেত্রে নতুন কিছু নয়। তবুও এই লকডাউনের সময় সেই পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে আরও বেশি।

এর সঙ্গেই মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে এসেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফি বৃদ্ধির ঘটনা। একদিকে যেখানে সরকারি স্কুলগুলিতে ক্রমশ নিম্নগামী হয়েছে পড়াশোনার মান, অন্যদিকে সেখানে বেসরকারি স্কুলগুলোতে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পড়াশোনার খরচ। লকডাউনের সময় সমাজের সকল স্তরের মানুষেরই উপার্জনে ঘাটতি পড়েছিল। কর্মহীনও হয়েছেন কাতারে কাতারে মানুষ। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিও এই ভাবে লুটপাট চালানোয় সমস্যা তীব্রতর হয়েছে আরও।

আরও পড়ুন
ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের আর্জি কেন্দ্রের, অপপ্রচার আটকানোর আড়ালে কি বিরোধীদের কণ্ঠরোধ?

কবে থেকে শুরু হবে স্কুলে নিয়মিত পড়াশোনা? নির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই এখনও। কিন্তু পড়াশোনা পুনরায় শুরু হলেই যে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার, সে ব্যাপারে আদতেই কোনও নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি এখনও। পর্যাপ্ত জল এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার মতো নিরাপদ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে পারেনি এখনও বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যদিও এর মধ্যেই সরকার ২১শে সেপ্টেম্বর থেকে নবম ও দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যায়ক্রমে স্কুল চালু করার ভাবনার কথা জানিয়েছে। এর জন্য নির্দিষ্ট গাইডলাইনও প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রক। কিন্তু তা সত্ত্বেও মূল সমস্যাগুলি নির্মূল করতে উল্লেখযোগ্য কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি এখনও কেন্দ্রকে। বরং লকডাউনের মাঝেই জোর করে বিভিন্ন পরীক্ষা গ্রহণ করতে একগুয়ে মনোভাবই দেখিয়ে গিয়েছে সরকার।

সব মিলিয়ে পরিস্থিতির কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে বারবার ছাত্র ও শিক্ষা সমাজকেই। দেশের ভবিষ্যতের জন্য যে এই ঘটনা মোটেই আশাপ্রদ নয়, তা বুঝতে আহামরি জ্ঞান লাগে না। কিন্তু তবুও সরকারের তরফ থেকে নির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনা এখনো দেখতে না পাওয়া যথেষ্ট আশ্চর্যজনক। এই পরিস্থিতির উন্নতি করতে যত তাড়াতাড়ি সরকারের মতি ফেরে, ততই মঙ্গল দেশের আগামী সময়ের কাণ্ডারীদের।

(মতামত লেখকদের ব্যক্তিগত)

আরও পড়ুন
লকডাউনে খাদের কিনারায় দলিত, মুসলিম এবং আদিবাসীরা, পৌঁছোয়নি ত্রাণও; প্রকাশ সমীক্ষায়

Powered by Froala Editor

More From Author See More