যশোর রোডে তিন শতাধিক বৃক্ষচ্ছেদন, রায় সুপ্রিম কোর্টের

দু’দিকে প্রকাণ্ড সব বৃদ্ধ গাছেদের সারি। আর তাদের বুক চিরে চলে গেছে চওড়া রাস্তা। জুড়ে রেখেছে দুই বাংলাকে। যশোর রোড (Jessore Road)। পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, এই রাস্তার সঙ্গেই জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস, অজস্র কাহিনি, ঐতিহ্য, গৌরব, কখনও আবার যন্ত্রণাও। আর এইসব ইতিহাসের সাক্ষী রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকা অজস্র শতাব্দীপ্রাচীন গাছ। বছর কয়েক আগের কথা উন্নয়নের তাগিদেই সেই গাছ কাটার নিদান দিয়েছিল সরকার। তার পরই গড়ে ওঠে স্বতঃস্ফূর্ত এক গণআন্দোলন। প্রাচীন এই বৃক্ষগুলি রক্ষা করতে জোট বেঁধেছিলেন সাধারণ মানুষ, সমাজকর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং পরিবেশবিদরা। তবে শেষ রক্ষা হল না। শেষ অবধি সর্বোচ্চ আদালতের রায় গেল এই গণআন্দোলনের বিপক্ষেই।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টে শুনানি হয়েছিল সংশ্লিষ্ট মামলাটির। আর সেখানেই সরকারকে তিন শতাধিক গাছ কাটার অনুমতি দেন বিচারপতি বিক্রম নাথ এবং বিআর গাভাই-এর বেঞ্চ। বহাল থাকে কলকাতা হাইকোর্টের দেওয়া রায়। অবশ্য তা নিয়েও ধন্দ রয়েছে বেশ। সেটা কেমন? এই উত্তর পেতে ফিরে যেতে হবে ২০১৮ সালে।

“যশোর রোডের গাছ কাটার কথা ঘোষণা হওয়ার পর, প্রথম আদালতে মামলা করে এপিডিআর বারাসাত শাখা। তখনও পর্যন্ত বিষয়টা সাধারণ মানুষ জানত না। পরে বিষয়টি জানতে পেরে ছাত্রছাত্রীরা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজন এবং সাংস্কৃতিক ও সমাজকর্মীরা যুক্ত হন এই আন্দোলনে। পরে ছাত্রছাত্রীরাও পৃথকভাবে আদালতে একটি মামলা করে। সেই মামলার প্রেক্ষিতেই গাছ কাটায় স্থগিতাদেশ জারি করেছিল আদালত।”

বলছিলেন কবি বিভাস রায়চৌধুরী। বিভাসবাবুর মতোই বহু সংস্কৃতিমনা মানুষও জড়িয়ে ছিলেন এই আন্দোলনের সঙ্গে। না, বিভাসবাবু রাজনীতি কিংবা কোনো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নয়, বরং একজন সচেতন নাগরিক হয়েই সরব হয়েছিলেন গাছ কাটার প্রতিবাদে।  

প্রাথমিকভাবে এই আন্দোলনের কারণে বৃক্ষচ্ছেদনে স্থগিতাদেশ জারি করেছিল অ্যাপেক্স আদালত। পরে কলকাতা হাইকোর্টে গাছ কাটার নিদান দিলে মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্টে। তৈরি হয়েছিল বিশেষ পর্যবেক্ষণ কমিটি। তাঁদের পেশ করা রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই শেষ অবধি কলকাতা হাইকোর্টের রায় বহাল রাখার নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট। অবশ্য, কয়েক হাজার গাছ কাটার পরিবর্তে উন্নয়নের স্বার্থে ৩ শতাধিক গাছ কাটা হবে বলেই জানানো হয়েছে এই রায়ে। 

তবে এই রায় নিয়ে ধন্দ থেকেই যাচ্ছে। কারণ, প্রাথমিকভাবে রাস্তা চওড়া করার জন্যই গাছ কাটার নিদান দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। অবশ্য, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে তিন শতাধিক গাছ কাটা পড়বে রেলওয়ে ওভারব্রিজ নির্মাণের জন্য। “একবার রেলওয়ে ব্রিজের জন্য গাছ কাটা হলে, পরে আবার রাস্তা প্রশস্ত করার জন্যও গাছ কাটা হবে। রাষ্ট্র খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য যেভাবে আদিবাসীদের সরিয়ে দিয়েছে, সেভাবেই এখানকার এই গাছগুলোকে বাঁচানো হয়তো সম্ভব হবে না আর”, জানালেন বিভাস রায়চৌধুরী।

প্রশ্ন থেকে যায়, শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহাসিক গাছগুলিকে কেটে ফেলা ছাড়া সত্যিই কি কোনো উপায় ছিল না উন্নয়নের? ছিল বৈকি। বিশ্বের অনেক দেশেই গাছ রক্ষার স্বার্থে গাছের দু’দিক দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়। কখনও আবার সমূলে গাছকে তুলে ফেলে স্থানান্তরিত করা হয় অন্যত্র। বিভাসবাবুর থেকে জানা গেল, এধরনের একাধিক বিকল্পের কথা উল্লেখ করেই আদালতে আবেদন পেশ করেছিলেন আন্দোলনকারীরা। তবে তাতে খুব একটা কর্ণপাত করেনি বিচার ব্যবস্থা। তবে এভাবেই কি নিস্তেজ হয়ে পড়বে এক স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলন?

সেই উত্তর পাওয়া গেল না বিভাসবাবুর থেকে। তাঁর কথায়, “সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পর বুক চাপড়ে হার হোসেন হায় হাসান করা ছাড়া, আর কী করার আছে আমরা জানি না। বহু সাধারণ মানুষ জড়িয়ে ছিলেন এই আন্দোলনের সঙ্গে। সকলের কাছেই এই রায় একটা বড়ো ধাক্কা। আমরা এই গাছগুলোর সঙ্গেই তো বসবাস করেছি এতকাল। অল্প কিছু মাফিয়া ছাড়া সকলের কাছেই এটা খুব কষ্টকর!” 

Powered by Froala Editor