ভাঙায় গড়া মানুষ

প্রহরে প্রবেশ।

নাকি ‘অনুপ্রবেশ’ বলাটাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত হবে? 

প্রহরের প্রহরীবৃন্দ বয়সে আমার পুত্রসম, ঝকঝকে, যৌবনে টলটলায়মান। আমার কেসটা কি তাহলে শিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢোকার মতো হয়ে গেল না? নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছি এই বলে যে বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা থাকলে মহাভারত যদি অশুদ্ধ না হয়,  তাহলে চিরকুমার সভায় আমার প্রবেশেই বা হতে যাবে কেন? বয়স তো কেবলই একটা শুষ্কং কাষ্ঠং নম্বর, ইয়ে দিল তো মাঙ্গে মোর!

খুব ভাল করে ভেবে দেখেছি আমি মোটামুটি তিনটি কাজ চলনসই গোছের করতে পারি - পড়তে, বলতে আর লিখতে। পড়ার কাজটা সারতে হয় নিভৃতে, সেটা বইয়ের সঙ্গে আমার একান্ত বোঝাপড়া। সংসারে বইয়ের চেয়ে উত্তম সঙ্গী কেউ নেই,  আমার কাছে বই সর্বরোগহর বটিকা। ইন্টারনেটের দাপটে বই-হীন পৃথিবীর সীমানা জোয়ারের জলের মতো বাড়ছে দেখলে আমার বড্ড কষ্ট হয়, মনে মনে প্রার্থনা করি, গুগল বইয়ের সর্বাঙ্গীন বিকল্প হয়ে ওঠার আগে পৃথিবীটা যেন ধ্বংস হয়ে যায়।

পড়ার মতো বকবক করতেও আমি বেদম ভালোবাসি। ইস্কুলে এই বদভ্যাসের জন্য এক মাস্টারমশাই আমার নাম দিয়েছিলেন, ‘ফরফরিদাস’। টেলিভিশনের স্টুডিওয় বসে পার্থির-অপার্থিব সব বিষয়েই বকবক করেছি অনেকদিন। যা সত্য মনে করেছি সেটাই বলেছি, ঠোঁটকাটা হিসেবে কিছুটা খ্যাতিও ছিল আমার। এখন অবশ্য সে সুযোগই আর কেউ দেয় না, আমি ব্রাত্যজন।তবে উল্টো দিকের কথাটাও একই রকম সত্য। সুযোগ থাকলেও আমি আর টেলিভিশন স্টুডিওমুখো হব না। কেন? বোবার কোনও শত্রু থাকে না, তাই। পণ্ডিতকুল সাবধান করে বলেছেন বটে ‘শতম বদ মা লিখ’, আমি সচেতনভাবে উপদেশটি উল্টো করে পালন করছি। চেষ্টা করে, সাতপাঁচ ভেবে কলমকে আমি যদিবা বশে রাখতে পারি জিহ্বাকে কিছুতেই পারি না যে! স্বভাবের জন্য মরার চেয়ে স্বভাব ভুলে যাওয়াই তো ভালো!

বাকি রইল লেখালেখি। চল্লিশ বছর ধরে কত লাখ(নাকি কোটি হবে) শব্দ যে লিখেছি ভাবলে মাথাটা ঝিমঝিম করে। লেখা মানে হয় সংবাদ নয় সংবাদ-ভাষ্য, সবই ক্ষণিকের ব্যাপার, ইতিহাসের আস্তাকুড় ছাড়া অন্যত্র কোথাও তাদের জায়গা হবে না। সময়, সংবাদ, মালিক এই ত্রিমূর্তির সেবা করতে করতেই জীবনটা কাটিয়ে দিলাম, সেবাদাস হিসেবে নাম-ডাকও হয়েছিল কিঞ্চিৎ। তা বলে এ নিয়ে কি আমার মনস্তাপ আছে? কিংবা অনুশোচনাবোধ? একেবারেই নয়। আমার অধ্যাপক পিতার ইচ্ছাকে অমান্য করে, শিক্ষকতার পেশায় না গিয়ে আমি খবরের কাগজে ঢুকেছিলাম আজ থেকে ঠিক চল্লিশ বছর আগে। সেটা ছিল আমার সচেতন, স্বাধীন সিদ্ধান্ত। কেউ আমাকে সাংবাদিক হওয়ার পরামর্শ দেয়নি, আমার ত্রি-কুলে কেউ কখনও সাংবাদিক হওয়ার কথা ভেবেছে বলেও শুনিনি। কেন গিয়েছিলাম?

মন মজলে কেউ যেমন প্রণয়ণীর জাত বিচার করতে বসে না, আমিও ঠিক তাই করেছি, আশৈশব লালন করে আসা একটা ভালোবাসার কাছে আত্মসমর্পণ করেছি। ইস্কুলে থাকতেই আমি স্বপ্ন দেখতাম, সাংবাদিক হব। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সেটা প্রত্যয় এবং অঙ্গীকারে পর্যবসিত হল। তখন মনে হল সাংবাদিক ছাড়া আমি আর কিছুই হব না, অনেকটা উইলস সিগারেটের সেই বিখ্যাত বিজ্ঞাপনী স্লোগানের মতো, ‘মেড ফর ইচ আদার’। সাংবাদিকতা আর আমি আমি আর সাংবাদিকতা। অনেকটা যেন নিশির ডাক, অমান্য করব, সাধ্য কই?

বাবা খবরের কাগজে চাকরি করাটাকে ‘ভদ্দরলোকের ছেলের’ উপযুক্ত কাজ মনে করতেন না।অথচ বাবাই বহু বছর ধরে আনন্দবাজার ও হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডে, বাংলায় এবং ইংরেজিতে ফিচার লিখেছেন অসংখ্য। বাবা ম্যাট্রিকে বাংলায় লেটার পেয়েছিলেন, বাংলা গদ্য তাঁর হাতে অপরূপ শিল্প-কর্ম হয়ে উঠত অনায়াসে। বাবার আশৈশব ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছিলেন সন্তোষ কুমার ঘোষ, সেই সূত্রেই সুতারকিন স্ট্রিটের সঙ্গে বাবার গাঁটছড়া। সন্তোষবাবু অনেক সময় ভাবাতুর হয়ে বলতেন, প্রিয় বন্ধুকে জীবনের বাকি সব খেলায় হারিয়ে দিতে পারলেও একটি জায়গায় তিনি গো-হারান হেরে বসে আছেন। আমার বাবার মতো বাংলা গদ্য তিনি নাকি লিখে উঠতে পারেননি।

বাংলা গদ্য লেখায় নিজেকে আমি ‘বাপ কা বেটা’ বলব না কিছুতেই। সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য হল ‘কমিউনিকেশন’, তার ভাষা লেখক নিজে যতটা না তৈরি করে তার চেয়েও বেশি বাজারের বাধ্যবাধকতা তৈরি করে দেয়। হাতেখড়ির দিন থেকে শুনে এসেছি, খবর লিখতে হবে এমন সহজ, সরল ভাষায় যা মা-মাসিমারা চট করে বুঝে নিতে পারেন। সহজ কথা সহজে লেখাটাও আদৌ সহজ কাজ নয়। সহজ না হলেও অসাধ্য কিছু নয়, লাগাতার অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে সংযোগের সহজ ভাষাকে পোষ্য করে তোলা যায়। তাই বলে কি সাংবাদিকতার ভাষা  শিল্প-সুষমা মণ্ডিত? জাগতিক নানা বিষয়ে বোকার হদ্দ হলেও এমন দাবি করার মতো নিরেট-নির্বোধ আমি নই। আমরা দাঁড়কাক, পেখম তোলা ময়ূর নই।

সাংবাদিকতার পেশা নির্বাচনের মুখে এমনকি তারপরেও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে বাংলার বদলে ইংরেজিতে প্রবেশের পরামর্শ দিয়েছিলেন, আমি মানিনি। মাতৃভাষার প্রতি আমার যে নাড়ির টান সেটা ছিঁড়ে ফেলা অসম্ভব ছিল। ছিল একটা স্বপ্নিল অঙ্কও। আমার মনে হয়েছিল ভারতীয় দলের ষোলো জনের একজন হওয়ার চেয়ে বাংলা টিমের ক্যাপ্টেন হওয়া অনেক ভালো, সহজতর। সামনে একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ না থাকলে আমার শরীর গরম হয় না, অ্যাড্রিনালিন ভেজা বারুদ হয়ে থাকে, কিছুদিন যেতে না যেতেই হাঁফিয়ে উঠি। সেজন্যই প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটকে রাম রাম করে দেওয়ার পরে আমি ক্রমাগত নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে গিয়েছি, সফল হইনি, খাল কেটে কুমির ডেকেছি, অকল্পনীয় অপমান, লাঞ্ছনা আর প্রতিহিংসায় দগ্ধ হয়েছি। শরীর ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছে, মনের অবস্থা তথৈবচ তবু, ‘হোসলা বুলন্দ হ্যায়’।

আমি তাই, শক্তিদার কাব্যের ভাষায় বলতে গেলে, ‘ভাঙায় গড়া মানুষ’, এতেই আমার আনন্দ, আমার প্রাপ্তিসুখ। অচিরে চিত্রগুপ্ত যখন জানতে চাইবে অভিজ্ঞতার ঝুলিতে কী কী মণিমুক্তো আছে আমি কলার তুলে গড়গড় করে যা বলতে পারব অনেকেই তা পারবে না। তাই চিত্রগুপ্তের ইন্টারভিউতে আমার ফুল মার্কস পাওয়া নিশ্চিত।

সংবাদজীবিকায় একটা ছোটো শূন্যস্থান ছিল। ডট কম, ডট ইন, ডট...।

প্রহরের তরুণ তুর্কীরা বৃদ্ধকে সেই শূন্যস্থান ভরাট করার একটা সুযোগ দিল। ‘অচেনাকে ভয় কী আমার ওরে’ গুনগুন করতে করতে আমি সোৎসাহে রাজি হয়ে গেলাম। এবার থেকে সপ্তাহে দু’টো দিন আমি লিখব এখানে।

কার্টুন - উদয় দেব

Powered by Froala Editor