ছুটন্ত ট্রেন আর প্রিয় মানুষের বাড়িয়ে দেওয়া হাত, পর্দার বাইরেও অপেক্ষা সেই ভরসারই

দু’বছর হয়ে এল, বালুরঘাটে আমার বাড়ির উঠোনের শিউলিগাছের তলায় পরে থাকা ফুলগুলোর গন্ধ আর পাই না!

রোজই প্রায় ঠাকুমার সঙ্গে ফোনে কথা হয়। তার গোপালের গল্প, তার স্বপাকে কী রাঁধল সে-গল্প। কিন্তু ঠাকুমার আঁচল জড়িয়ে শোয়া হয় না আর!

‘শুভ মঙ্গলম যাদা সাবধান’ আজ, আমি আর আমার জীবনসঙ্গী রবি, প্রথম শোতেই দেখে নিলাম!

দীর্ঘদিন বাদে আজই কর্ণজোড়া থেকে একরকম ছুটেই চলে এসেছে রবি! একসঙ্গে ‘আমাদের গল্প’ দেখবে বলে!

আমায় যারা জানেন, তারা জানেন যে, আমিও কথায় কথায় খিল্লি করি, হা হা করি, ছবিটার মতোই! শুধু খুব কাছের কেউ কেউ বলে ‘তুম ইতনা জো মুসকুরা রাহে হো...’!

কার্তিক সিং-এর চরিত্রটাও কথায় কথায় দর্শককে খোরাক জোগান দেয়!

ওর প্রেমিক আমান ত্রিপাঠী-কে রেলের কামরায় লিপ কিস করতে, আমানের বাবা দেখে নিলে, আমান যখন বলে ‘কেন নজর রাখোনি’, ও বলে ‘আরে জানো তো, তোমায় চুমু খেলে আবেগে আমার চোখ বন্ধ হয়ে যায়! তুমি তো সবসময় নজর রাখো!’ আর আমান বলে ‘এইবার প্রথম মন দিয়ে করছিলাম, ডুবে গেছিলাম ইয়ার! তুমিই তো বল সবসময় প্রেমের সময় আমার মন অন্য দিকে থাকে। এই জন্যই তো থাকে! এইবারই ডুবে গেছিলাম আর পড়বি তো পড় বাবার সামনে!’ আমানের বাবা তখন ট্রেনের দরজা দিয়ে বমি করে অজ্ঞান। পরিবার ভাবছে দিন রাত কপি খেয়ে গ্যাস হয়ে গেছে। হল জুড়ে হি হি!

আমাদের দুজনের বুকটা খাঁ খাঁ করে ওঠে! কারণ ওই ‘ধরা পড়ার ভয়’টা আমাদের কাছে যে বড় বাস্তব ছিল, খিল্লি নয়!

কার্তিক আমানকে জোর করে ওদের ইলাহাবাদের বাড়িতে, আমানের বোনের বিয়েতে নিয়ে যায়! কারণ কার্তিক ত্যাজ্য! ওর পরিবার নেই। আমানের তো আছে! সেই ভাই, বোন, মা, বাবা, কাকা, কাকী, হইচই কার্তিকের কাছে পরম আদরের। আমান বোঝায় কেউ বুঝবে না! কার্তিক বলে ‘আমার বাবা তো কামার, শুধু পেটাতে জানে। তোমার বাবা তো ত্রিপাঠী, তায় বিজ্ঞানী, ঠিক বুঝবে।’

পরে যখন ওই বাড়িতে বেদম মারধোর হয় কার্তিকের, আমান চিৎকার করে ওর প্রেমিককে বলে ‘এই শিক্ষার ক্ষেত্রে বামুন, কামার এক।’

আমার চোখের সামনে রবির বিধবা মা’র বাড়িতে, বাড়ি থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া আর সেখানে দলবল নিয়ে আমার ‘শিক্ষিত’ পরিবারের লোকেদের চড়াও হওয়ার সাক্ষী থেকেছি। জোর করে আমাকে টেনে, হিঁচড়ে বের করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা, আমাকে নগ্ন করে, আমি ‘হিজড়ে’ হয়েছি কিনা দেখার চেষ্টার সেই ভয়ঙ্কর রাতটা ভেসে ওঠে! আমি প্রাণপণে গ্রিল ধরে নিজেকে আটকে রাখছি,। আর রবি পুলিশ, সংগঠন সবাইকে ফোন করে চিৎকার করে সাহায্য চাইছে!

ছবিটা জুড়ে আপনি হাসতে পারবেন। প্রচুর খোরাক আছে। শুধু যারা, এই রাস্তায় হাঁটছে, হেঁটেছে, তাদের রুমাল ভিজবে! হাসিটা জরুরি, না হলে এই বার্তাগুলো নিতেও লোকে আসবে না। ছবি তো আর রিসার্চ পেপার নয় যে লাইব্রেরিতে যাবেন!

ছোটবেলায় আঘাত পেয়ে একটা চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়া, পাথরের চোখ বসানো ‘গগলস’ নামে খ্যাত হয়ে যাওয়া (কারণ বুলি হওয়ার থেকে বাঁচতে দিনে-রাতে ও কালো রোদচশমা পরে থাকে) আমানের বিয়ে-পাগল বোন আপনাকে হাসবে। কিন্তু এই পুরুষতান্ত্রিক পরিবারে চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়া মেয়েটির প্রতি মুহূর্তের খোঁটা খাওয়া দেখতে আর বুঝতে পারলে, ছবিটি আর সেক্সিস্ট মনে হবে না আপনার। বরং ওর মধ্যের ব্ল্যাক হিউমার মোচড় দেবে বুকে!

কেন, কার্তিক আর আমান ওদের সম্পর্কের কথা বাড়িতে চেপে রেখে, দিল্লিতে নিরুপদ্রব জীবন ছেড়ে, শখ করে বাড়ির সঙ্গে কথা বলতে এল, এটা ভাবলে, বুঝবেন সমকামী-তে ‘কাম’টাই শুরু আর শেষ নয়। ভালোবাসা আর একটা ভালোবাসা পাওয়ার আর্তি আমাদের কতটা তাড়া করে বেড়ায় দিনেরাতে!

আমার বাবার সঙ্গে প্রতিদিন দু’বেলা ফোনে কথা হয় আজও!

যত না বেশি কথা হয়, ঝগড়া, খুনোখুনি হয় কয়েকগুণ!

তবু ওই ভদ্রলোকও নিয়ম করে ফোন করেন, আর আমি নিয়ম করে যোগাযোগ রাখি।

কারণ আমার ফেলা আসা ঘরের গন্ধ, বাগানের শিউলির গন্ধ, ঠাকুমার আঁচলে আমার শৈশব, সবটাই টিকে আছে ওই ফোনকলের মধ্যে।

জানি একদিন ওটাও হয়তো ফুরিয়ে যাবে। পরিবারের অন্যদের অন্ধ সংস্কারের কাছের হারিয়ে যাবে আমার শৈশব, আমার কৈশোর, আমার আধখানা জীবন!

তবু আশা থাকে!

হয়তো একদিন, হয়তো কোনো একদিন, আমানের বাবার মতো কেউ বলবে, ফিল্মি কায়দায় ‘আমাদের না বোঝার জন্য তোদের জীবনটা নষ্ট করিস না। যা সিমরান, জি লে আপনি জিন্দগি!’

শেষ দৃশ্যে চলন্ত ট্রেনের কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে ছুটতে থাকা আমানের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় কার্তিক, যে কিনা প্রথম দৃশ্যে ছুটে আসছিল, হাত বাড়িয়ে রাখা আমানের দিকে!

পাল্টে যায় সমাজ নির্মিত চরিত্র!

বলে দেয়, দয়া করে আমাদের মধ্যে কে ‘ছেলে’ আর কে ‘মেয়ে’ জিজ্ঞাসা করবেন না! কারণ বিষম-প্রেমের বাইরে এই কাঠামোটাই অবান্তর।

ওটা আমাদের নিজেদের ভালোলাগা। ওটা আরোপিত নয়!

তবে শেষ অবধি বসে থাকবেন, কারণ কুশীলবদের নাম পর্দায় ওঠার আগেও আছে বার্তা! 

আশির দশকের জনপ্রিয়তম গানের মধ্য দিয়ে, হল জুড়ে বাজছে ‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না, তার সাথে নাই লেনা দেনা...’

আর ওই সুরে, ভেসে যাচ্ছে, আত্রেয়ী দিয়ে, আমার ঘর, আমার শিউলি ফুল, রবির ছেলেবেলার মাঠ, বান্ধবীরা!

More From Author See More